ক্যালিফোর্নিয়া শীর্ষ খবর হাইলাইটস

রাতজাগা শহর লাস ভেগাস : অস্থির লাগা ভয়ংকর সব সুন্দরে ঘোরাঘুরি

শুভেচ্ছার অস্থির লাগছে। রুপন দা’র ওয়ান্স ইন এ লাইফ টাইম। বাঁধনের ড্রাইভিং সিট। নয়ন ঘোষের এবার দু’হাজার। ভ্রমণের ছোট্ট বন্ধু রিতুল (গণেশ)-এর বেড ওয়াটার সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে আমরা এগারজন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যগুলোর ভয়ংকর সব সুন্দর উপভোগ করেছিলাম টানা এক সপ্তাহ। যেখানে প্রকৃতি নুইয়ে পড়েছে তার নান্দনিক সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে । আর এসব রাজ্যগুলো অ্যারিজোনা, নাভেদা, ইউটা, নিউ মেক্সিকো, কলোরাডো – সাথে ছিল রাতজাগা শহর লাসভেগাস !

vv
দিনদিন মানুষের ভিড় বাড়ছে এসব এলাকায়। প্রতিদিন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুঁটে আসছেন ভ্রমণপিপাসু মানুষ। গ্রান্ড ক্যানিয়ন, এন্টিলপ ক্যানিয়ন, জিওন ন্যাশনাল পার্ক, ডেড ভ্যালী বেড ওয়াটার – কালের সাক্ষী এসব প্রাকৃতিক নিদর্শন ঠাঁই দাঁড়িয়ে যেন জানান দিচ্ছে – আমরা তোমাদের সুখের জন্য ছিলাম-আছি-থাকবো। প্রকৃতিকে ধরে রাখার পেছনে এসব অঞ্চলের আদিবাসীদের (নেটিভ আমেরিকান) অবদান রাষ্ট্র স্বীকৃত।

এক সপ্তাহ (১৮-২৪ নভেম্বর) ছুটির ফাঁদে (থ্যাংকস গিভিং ডে) ছিল পুরো আমেরিকা। আমাদের মত অনেকে এ সময়টিকে ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। আঠার নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী অঙ্গরাজ্য ক্যানসাসের উচিটা শহর থেকে সোজা আমেরিকার উত্তর–পশ্চিমের রাজ্যগুলো ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে জার্নি বাই কার। যেন সমতল থেকে পাহাড়ে ঘুরে আসা । এ সময়টিতে ওসব অঞ্চলে শীত-বসন্তের মাঝামাঝিতে প্রকৃতি সেজেছে অন্যরকম সাজে । তারাভরা রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠেলে গাড়ি ছুটছে। এসব পাহাড়ি জনপদে প্রকৃতির ভিন্নতা চোখে পড়ার মত। কোথাও তুষার বরফে ঢেকে যাচ্ছে,, কোথাও রাতের আলোয় মানুষের পদভারে শহর আলোকিত হয়ে উঠেছে। ইন্টারস্টেট হাইওয়ে-৪০ ধরে ওকলাহোমা-নিউ মেক্সিকো, কলোরাডো, অ্যারিজোনা হয়ে রাতের আলো জ্বলমলে শহর লাসভেগাসে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাসিনো শহর লাস-ভেগাস । চারিদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড়। রাতে মনে হয় যেন সবুজের মাঝে একখন্ড ঝকঝকে সোনা। একের ভেতর অনেক। বিশ্বজুড়ে যে শহরের রাতে না ঘুমানোর খ্যাতি রয়েছে । ভেগাস তার মধ্যে অন্যতম। ভেগাসের ভলিভাড সড়ক (স্টিভ)! এ যেন আলোর মিছিলে রাত জাগা এলিয়ন ( দৈত্যদানব ) সুপারসনিক গতিতে ছুটে চলেছে আইফেল টাওয়ার থেকে ট্টাম্প টা্ওয়ার। আলো জ্বলমলে হৈ-হৈ রৈ-রৈ শহরের মাঝখানে বাদ্যের তালেতালে “ফাউন্টেন শো” জলতরঙ্গের খেলা। মনে হচ্ছে, শহরজুড়ে ডলার (টাকা) উড়ছে । শহরজুড়ে ক্যাসিনোর স্লট ম্যাসিনের বিকট আওয়াজ । পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষ কচকচে ডলার নিয়ে স্রোতের বানে এ শহরের ক্যাসিনোতে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। এ শহরে ঢুকলে যে কোন আগন্তুক নিজেকে আপন-মননে খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হবে। নির্ঘুম ভেগাস শহর নিয়ে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে –“What happens in Vegas Stays in Vegas”।

r4লাস ভেগাস থেকে পাহাড়ী আঁকা-বাকা পথ ধরে ২৭০ মাইল দূরে গ্রান্ড ক্যানিয়ন । যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যে গ্রান্ড ক্যানিয়ন। যা পৃথিবীর সবোচ্চ গিরিখাত নামে সুপরিচিত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলোর মধ্যে গ্রান্ড ক্যানিয়ন অন্যতম। জানা যায়, প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই গিরিখাতের সংরক্ষণে একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রায়ই এখানে শিকার এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসতেন। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দৈর্ঘ্যে ২৭৭ মাইল, প্রস্থে সর্বোচচ ১৮ মাইল এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১ মাইলেরও অধিক। এর মধ্য দিয়ে কলোরাডো নদী বয়ে গেছে। ভূতত্ববিদদের ধারণা, ১৭ বছর মিলিয়ন আগে এ গিরিখাতের সৃষ্টি। আগামী ২০ লাখ বছর পর এ গিরিখাতটি আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। মিলিয়ন বছরেরও আগের এ ভয়ংকর সুন্দর ক্যানিয়ন নানা রংয়ের পাথর নিয়ে এখনও ঠাই দাড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গবেষণায় উঠে এসেছে- যুগ-যুগান্তরের সাক্ষী হয়ে এসব পাথুরে পাহাড় এখনো মানুষের বিস্ময়ের কারণ হিবেসে রয়ে গেছে। একমাইলেরও অধিক গভীর গিরিখাতের ৮টি স্তর ( Kaibab formation, Coconion sandstone, supia group, Redwall limestone, Tonto group, Grand Canyon Super Group, Vishnu basement Rocks) একেকটি কালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ যেন অনিন্দ্য সুন্দর পাথুরে স্থাপত্য ।

খাতের সুউচ্চ সীমানা রেলিং দিয়ে ঘেরা রয়েছে। তবুও মনে হয় এ বুঝি পড়লাম। অনেক পর্যটককে হেলিকপ্টার যোগে গিরিখাতের এ বর্ণিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেখা গেছে। প্রকৃতির এ বিস্ময় দেখে যে কোন পর্যটক মুগ্ধ না হয়ে ফিরবেন না। উত্তর-দক্ষিণে দুদিক থেকে গিরিখাত অবলোকন করা যায়। এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে আসতে ২২০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়।

প্রকৃতির নান্দনিক খেয়ালিপনা ”এন্টিলপ ক্যানিয়ন”। পাহাড়ের উপরে-নিচে দুটো ক্যানিয়ন রয়েছে। উপর থেকে ১৩৩৫ ফুট নিচে পাথরের স্তুপে জলের খেলা। আকা-বাঁকা পাহাড়ী মরুপথে নাভাজো উপজাতি (নেটিভ আমেরিকান) পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানায়। পযটকদের গাইড হিসেবে কাজ করে নাভাজো উপজাতি যুবক-যুবতীরা। এরা নিজেদের রেড ইন্ডিয়ান (নেটিভ আমেরিকান) হিসেবে পরিচয় দিতে খুব স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। মাঝি নামের এক গাইড আমাদের চাঁদের গাড়িতে করে মরুভূমির ধুলো উড়িয়ে নিয়ে যান এন্টিলপ ক্যানিয়নের দোড়গোড়ায়। এ যেন প্রাকৃতিক কারুকার্য শোভিত পাহাড়ি আঁকাবাকা সুড়ঙ্গ। উপর থেকে সূর্যের আলো উকিঁ দিচ্ছে। যতই ভেতরে প্রবেশ করি ততই বিষ্ময়! ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে সুড়ঙ্গের আলো-আধারী পরিবেশ বণিল আলোয় সেজে উঠে। নতুন-অজানা পরিবেশে দক্ষ ফটোগ্রাফার না হলে ক্যামেরায় ক্লিক করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ইতোমধ্যে আলো-আধারী পরিবেশে লাইট এন্ড রেজুলেশন সেনসিটিভিটি ধারণ ক্ষমতাসমৃদ্ধ মোবাইল বেশ ভাল রেজাল্ট দিচ্ছে। এসব মোবাইলে যে কোন ভ্রমন পিপাসু মানুষ তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে পারবেন। অ্যারিজোনা রাজ্যের পেজ (page) এলাকায় এ বিশাল পাহাড়ী মরুদ্যানটি সংরক্ষণ করে রেখেছে সেখানকার নাভাজো উপজাতী (Navajo Nation) । এতে রয়েছে ডেড ভ্যালী ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় তিনহাজার ফুট উচু পাহাড়ের পাশ ঘেষে সল্ট ফল্টস বেড ওয়াটার। যা সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ২৮২ ফুট নিচে অবস্থান করছে। যেন ধবধবে সাদা লবনের কূলহারা নদী।

lv88আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যেন পাহাড় সাম্রাজ্য । আঁকাশছোয়া পাহাড় দিয়ে সাজানো। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে জাওন ন্যাশনাল পার্ক । বলা যায়, পৃথিবীর প্রকৃতি সংরক্ষণাগার। ভারজিন নদী থেকে ধেয়ে আসা স্বচ্ছ জলে পাথর, কাঠ, বন্যপ্রাণীর বসবাস। যেখানে মানুষ-বন্যপ্রাণী হাত ধরাধরি করে চলে। হোভার ড্যাম – এটি একটি জলবিদ্যুৎ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। ১৯৩৬ সালে কংক্রিটের পাহাড় ভেঙে এ ড্যাম করা হয়েছে। এ পযন্ত এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭শ মিলিয়ন্ ডলার। এটি অ্যারিজোনা এবং নাভেদা রাজ্যকে ভাগ করেছে। মজার ব্যাপার হলো; এ দুটো রাজ্যের মধ্যে একশ হাত ‍দূরত্বে সময়ের হেরফের চোখে পড়ার মত। ড্যামের দুপাড়ে দুটো ঘড়িতে ৪৫ মিনিট সময়ের ব্যবধান লক্ষ্য করা গেছে। দিনের তাপমাত্রার উঠানামা সাদাচোখে দেখা গেছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকে ড্যামের দুপাশ সরগরম থাকে।

ভ্রমণের আদ্যপ্রান্তে সবার মুখে একটি কথা উচ্চারিত হচ্ছিল – “ওয়ান্স ইন এ লাইফ টাইম!” এক জনমে (জীবনে) কারো পক্ষে পুরো আমেরিকা ভ্রমণ আদৌ সম্ভব হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে মানুষ জীবনে একবার হলেও দেশ-দেশান্তর, মহাদেশ থেকে মহাকাশ ঘোরার সুযোগ পেলে হয়তো শুধু ঘোরাঘুরিতে থাকতো। ইচ্ছে ঘুড়িকে নিজের মত করে শুধুই ঘোরাতো। তবুও মানুষ ছুটছে পৃথিবীর বুক চিরে অন্য গ্রহে। কিন্তু তাকে (মানুষ) কোথাও না কোথাও নোঙর ফেলতে হয়। তাই বিশ্ব পরিভ্রাজক ইবনে বতুতা, কলম্বাস, ভাসকো-দা-গামার মত ভ্রমণপিপাসু মানুষকে প্রকৃতির অপার রহস্য দেখে থামতে হয়েছে। তাই অতৃপ্ত মন নিয়ে আমরা এগার জন সপ্তাহ ভ্রমন শেষে দক্ষিণ-পশ্চিম হাইওয়ে ১৫-৭০ সড়ক ধরে ক্যানসাসের দিকে ( স্পিড লিমিড ৭৫ মাইল) ছুটে এসেছিলাম। বারবার যেন পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরছিলেন দুরন্ত চালক বাঁধন। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা কলকাতা থেকে আসা নয়ন ঘোষ হঠাৎ গাড়ির হসপটে টাচ করলেন- অমনি বেজে উঠলো- আবার হবে তো দেখা, এ দেখা শেষ দেখা নয়তো…।