প্রবাস জীবন শীর্ষ খবর হাইলাইটস

পাহাড় আর রঙিন অরণ্যে

smok

ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে আমার মনোজগতের এক অদ্ভুত প্রেম। আমি ছিলাম ভ্রমণকাহিনির পোকা। সেই সব ভ্রমণকাহিনি আমায় নিয়ে যেত সেই পিরামিডের দেশে, আমাজনের জঙ্গল আর রেড ইন্ডিয়ানদের রহস্যময় জগতে। পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি আমায় চুম্বকের মতো টানত। এক ঘোর লাগা বিকেলে প্রকৃতি খুব রহস্য করে আমায় প্রশ্ন করে, বল না, কে বেশি সুন্দর? পাহাড় নাকি সমুদ্র? পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা ঝরনার ঝিরঝির শব্দ নাকি সমুদ্রের গর্জে আসা উত্তাল ঢেউ? পাহাড়ের চূড়ায় বসে সোনালি সন্ধ্যায় অরণ্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়া রবির কিরণ নাকি সমুদ্রের বিশালতায় গোধূলিবেলায় ঢেউয়ের ভিড়ে ডুবে যাওয়া অংশুর প্রভা? কী উত্তর দেব আমি? সমুদ্রের উত্তালতায় আমি বারবার ভেসে যেতে চাই। তার জলে আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আর পাহাড়ের রহস্যে আমি ভুলে যাই আমার অস্তিত্বকে। অরণ্যের মাঝে যেন মিশে থাকে আদিম শান্ত পবিত্র প্রেম। তাই প্রকৃতির উত্তরে আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে বলি, জানি না, জানি না, জানি না। শুধু জানি আমি তোমায় ভালোবাসি, সে তুমি যে রূপেই আস না কেন?

দেশে থাকতে বছরে একবার ঘুরতে যেতাম। কিন্তু আমেরিকায় এসে দেখলাম এখানে বেড়ানো তুলনামূলকভাবে সহজ। একটা ছোটখাটো দল হলেই হলো। এইবার আমরা গিয়েছিলাম আমেরিকার মোস্ট ভিজিটেড স্মোকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্ক দেখতে। আমরা আটজনের একদল গিয়েছিলাম। আমাদের এই ট্যুরের প্ল্যান বেশ আগে থেকেই করা ছিল। ফল কালার দেখতে যাব। এই সময় নাকি এই পাহাড়ি এলাকাটা রঙিন হয়ে ওঠে, প্রতিটি গাছ যেন নিজেকে রাঙিয়ে নেয় আপন ভালো লাগার রঙ্গে। রহস্যে ঘেরা এই পর্বতে আমরা দুই দিন থাকব। শনিবার সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হয় স্মোকি মাউন্টেনের উদ্দেশ্যে।
১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পর্বতমালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় পার্ক। বিদেশে এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্কগুলো কোনো দেয়াল বা সীমানা দিয়ে ঘেরা থাকে না। এই প্রাকৃতিক পার্কগুলোকে পার্ক না বলে সংরক্ষিত এলাকা বলা ভালো। বন, পাহাড়, হ্রদওয়ালা কিছু বিস্তীর্ণ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্ক বানানো হয়। এসব পার্কের ভেতর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে যথা সম্ভব কম আলোড়ন তুলে ভ্রমণকারীদের জন্য নগর জীবনের বেশির ভাগ সুবিধে যেমন হোটেল-রেস্তোরাঁ, এসব গড়ে তোলা হয়েছে।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমদের গাড়ি পাহাড়ের সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। গাড়ির জানালা গলে আমার বিমুগ্ধ নয়ন যেন হারিয়ে গেছে রঙের ধারায়। দুদিকে পাহাড়ের সারি, পাহাড়ের বুকে কিশোরীর মতো বাহারি রঙিন কাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে আলোয় রাঙা মহিরুহ। কী অদ্ভুত, কী অদ্ভুত সে সৌন্দর্য। দূর থেকে আরও দূরে আমার চোখ যেন পান করে নিচ্ছে প্রকৃতির এই অপরূপ সুধা। দুপাশে রঙিন প্রান্তর। তার ওপারে আকাশের বুকে হেলান দেওয়া পর্বতের সারি। পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলছে থমকে থমকে। আমাদের গন্তব্য কেডস কোপ নামক এক স্থানে। এটি এই এলাকার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জায়গা। প্রকৃতিকে আজ যেন সম্পূর্ণ এক নতুন রূপে আমার সামনে এসেছে। আমাদের গাড়ি চলছে দুই হাজার দুই শ মাইল এলাকা জুড়ে এলিয়ে পড়া এপেলেসিয়ান মাউন্টেন ট্রেইলের ভেতর দিয়ে। রাস্তার পাশেই বয়ে চলছে পাহাড়ি নদী। আমরা সবাই সেই নদীর বুকে পাথরের ডিবিগুলোতে বসে নদীর কূলকুল শব্দে বিমোহিত হয়েছি। হিমশীতল সেই জলের স্পর্শ আমায় শিহরিত করেছে। পাথরের বুক চিরে এই পানি ভেসে আসছে কোনো এক পাহাড়ের কান্না হয়ে। কী অদ্ভুত তার অনুভূতি।
সারা দিন পাহাড়ে ঘুরে রাতে আমরা যাই গেটলিনবার্গ শহরের এক রিসোর্টে। শান্ত আলো ঝলমলে ছোট পাহাড়ি শহর। পাহাড় ঘেরা এই শান্ত শহর আমায় গভীরভাবে টেনেছে। আমাদের রিসোর্টের একপাশে পাহাড় আর এক পাশে পাহাড়ি নদীর কূলকুল বয়ে চলা। আমরা পথিকের দল সেই রাতে বারবিকিউ পার্টি শেষে মাঝরাতে বেরিয়ে পড়লাম শহরটা ঘুরে দেখতে। মূলত এটি পর্যটন নগরী। মাঝরাতেও মানুষের জমজমাট আনাগোনা। আমরা শহরের কিছু দোকানে ঘুরে বেড়ালাম। সকালে নাশতা সেরে আবার বেরিয়ে পরলাম রঙের রাজ্যে। অদ্ভুত এই সময়। প্রতিটা গাছ সবুজের আবরণ ছেড়ে বিভিন্ন রঙে নিজেদের সাজিয়ে নিয়েছে। পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা যাচ্ছি চেরকি নামক এক গ্রামে। সেখানে আমেরিকার আদিম সমাজের প্রতিনিধি রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রাম। রাস্তার দুপাশে ডালপালা মেলে উজিয়ে উঠেছে বার্চ, ব্যাসউড, সিলভারবেল ও চেস্টনাট ট্রি। গাছপালার পেছনে আকাশের ক্যানভাসে নীল লাল, সবুজ আর ছাই রঙা পর্বতমালার সারি। কিছু কিছু গাছের সব পাতা ঝরে গেছে। সেই নগ্ন বৃক্ষগুলো যেন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে। কী বৈচিত্র্যময় এই প্রকৃতি, যেন শত শত রহস্যের ঢালি নিয়ে বসে আছে আমাদের মনোজগৎকে তোলপাড় করে দিতে। রাস্তার পাশে এক জায়গায় কিছু এল্ককে চড়ে বেড়াতে দেখলাম। বহু পর্যটক তাদের ছবি তুলছে। আমরাও কিছু ছবি তুলে নিলাম। রাস্তার পাশে পাশে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট। সেই পয়েন্টগুলো থেকে পাহাড়গুলোকে অদ্ভুত মায়াময় দেখায়। সেই রকম একটি পয়েন্ট হলো চিমনি মাউন্টেন ভিউ পয়েন্ট। এই জায়গাটাতে তিনটি পাহাড়ের মিলনস্থলের এক অদ্ভুত দৃশ্য যেন মাতাল করে দেয়।
স্মোকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কের একটি দৃশ্যরেড ইন্ডিয়ানদের আমি দেখেছি বইয়ের পাতায়। তাদের আমি আমার কল্পনার রাজ্যে আমার মতো করে গড়ে নিয়েছি। আজ সামনাসামনি তাদের দেখব, তাদের গ্রামে ঘুরে বেড়াব, কী উত্তেজনায় যে আমি দিশেহারা ছিলাম! বারবার মনে হচ্ছিল সত্যি কী আমি তাদের স্বচক্ষে দেখতে যাচ্ছি? চেরকি শহর ছাড়িয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রাম। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই গ্রামে ঢুকতে পারিনি। ভিজিটিং টাইম শেষ। সবাই একটু হতাশ, এত দূর এসে না দেখে ফিরে যাওয়া। আমার মনে হলো এ যেন আমায় আবার এখানে আসার নিমন্ত্রণ দেওয়া। আবার আস, ঘুরে যাও এই পাহাড় আর জেনে যাও আমাদের নতুন করে, আমাদের জাতিকে, কালের আবর্তনে আমরা আদিমবাসী যারা আজও আছি এই আদিম প্রকৃতিকে ভালোবেসে।
এইবার আমাদের যাত্রা গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনের সর্বোচ্চ চূড়া—ক্লিংম্যান্স ডোম। ক্লিংম্যান্স ডোম অবজারভেশন টাওয়ার। এপেলেসিয়ান মাউন্টেন রেঞ্জের সব চেয়ে উঁচু শৃঙ্গ। এইখানে যাওয়ার রাস্তায় আছে নিউ ফাউন্ড গ্যাপ নামক এক জায়গা। টেনেসি আর নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের মিলনস্থল। সূর্য আদিগন্ত জুড়ে তার প্রস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাহাড়ের বুকে গোধূলির মায়া ছড়িয়ে যেন নিজের দিকে টানছে আমাদের সবাইকে। আর তার টানেই সবাই ছুটে চলে ক্লিংম্যান্স ডোমে, সর্বোচ্চ চূড়া হতে রবির প্রস্থানের সাক্ষী হতে।
এপেলেসিয়ান মাউন্টেন রেঞ্জের সব চেয়ে উঁচু শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আমাদের পায়ের নিচে অসীম রহস্যে ঘেরা আদিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা। যত দূর চোখ যায় থরে থরে সাজানো বাহারি রঙের পর্বতমালার সারি। লাল-নীল, বেগুনি-সবুজের কত শেড! আমার চোখে ঘোর লাগছে। চারদিকে পাগল করা পৃথিবীর প্যানারমিক ভিউ! শুধু পর্বত আর পর্বতের সারি। বাঁকানো উপত্যকা আর এর মাঝে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর রুপালী সুতা। অরণ্য, নদী আর রবি আহা আহা! এ কোন ইন্দ্রালয়!
আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে এই অপরূপ রূপে। ভেতরে কেমন এক নিস্তব্ধ অনুভূতি, এক ঘোর লাগা ভালো লাগা। সামনে ফুলের পাপড়ির মতো পরতে পরতে সাজানো পর্বত সারি। সবচেয়ে কাছের পর্বতগুলোর রং লালচে সবুজ, তারপরে হালকা বেগুনি আরেকটু পেছনে নীলচে-সবুজ। আরও দূরে টারকুইজ ব্লু পর্বতমালার সারি—ধূসর গিরিশৃঙ্গ। তারপরে ডুবন্ত রবির নীরবে এতগুলো বিমোহিত চোখের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া। আমি আমার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে ভালো লাগার এক বিন্দুতে মিলে অরণ্য স্নানে নিমগ্ন কিছু অপার্থিব সময়কে যেন মনের গহিনের গহিনে আটকে রাখতে চেয়েছি…আহা!