আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্ক

যেখানে বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়ে এগিয়ে

sekh-hasinaআমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আর কিছুদিন পর, নভেম্বরে। সেখানকার বড় দুদলের হয়ে প্রার্থী হওয়ার জন্য গত কয়েক মাস প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কম কথা কাটাকাটি হয়নি; হয়েছে নানা রকম আলোচনা-সমালচনাও। শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান দলের হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মনোনয়ন পেয়েছেন। আর ডেমোক্রেট দলের হয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন হিলারি ক্লিনটন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে হিলারি ক্লিনটন যদি নির্বাচিত হয়েই যান, তাহলে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এ নিয়ে আমেরিকার গণমাধ্যমগুলোতে এর মধ্যেই শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ চলতি মাসের ৬ তারিখে চমৎকার একটি খবর প্রকাশ করেছে। ওই খবরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে তারা শিরোনাম করেছে: “যেখানে বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়েও অনেক এগিয়ে।”

ওই খবরে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের দুই নারী রাজনীতিবিদ ১৯৯১ সাল থেকে দেশ পরিচালনা করে আসছেন। শুধু যে তাঁরা দেশ পরিচালনা করেই আসছেন তা-ই নয়; তাঁরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়েছেন। যেটা অন্য কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে দেখাই যায় না।”

শুধু তাই না, তারা আরও লিখেছে, “বাংলাদেশের সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে এবং সরকারের অনেক শীর্ষ পদে অন্যান্য ধর্মের মানুষজন কাজ করছে। দেশটির বর্তমান প্রধান বিচারপতি নিজেও একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।”

আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যম কোন কারণে হঠাৎ করে বাংলাদেশকে নিয়ে খবরের শিরোনাম করেছে; সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে বোঝাই যাচ্ছে, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন যেহেতু একজন নারী প্রতিদ্বন্দ্বী এবং দেশটিতে যেহেতু এর আগে কখনও কোনো নারী প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হননি; তাই হয়তো মার্কিন গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে সামনে টেনে আনছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকা আর কয়টি দেশই-বা আছে? একজন নারী যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী দলের প্রধানও একজন নারী; আমরা বাংলাদেশিরা মনে হয় না এ নিয়ে এখন আর আলোচনা করি। আমাদের চিন্তাতেও হয়তো এখন আর বিষয়টি আসে না। আমরা এটিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখি।

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী ছিলেন। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন একজন নারী। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদেও নারী সদস্য আছেন। আমরা এ ব্যাপারটিকে রীতিমতো স্বাভাবিক মনে করলেও পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও উন্নত দেশটির অবস্থা কিন্তু ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজন এখনও ভাবছে, একজন নারী রাষ্ট্রপ্রধান হলে কেমন হবে!

তারা শেষ পর্যন্ত কাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করবে; সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এই যে একজন নারী প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়ছেন এবং তাঁর নারী পরিচয়টি বারবার সামনে চলে আসছে; সেই ভাবনার জায়গা থেকে আসলে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। তাই হয়তো আমেরিকার অনেক সংবাদমাধ্যম এখন বাংলাদেশকেই তাদের উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতে চাইছে। এই তো কিছুদিন আগে পৃথিবীর নামকরা পত্রিকা ‘ফোর্বস’ একটা শিরোনাম করেছে বাংলাদেশকে নিয়ে। সেখানে তারা লিখেছে, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হরতাল, এমনকি জঙ্গি হামলা– কোনো কিছুই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া থামাতে পারছে না; দেশটি কোনো এক আশ্চর্য মন্ত্রে এগিয়ে যাচ্ছে।”

একটা সময় বাংলাদেশে খুব ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি হতো। বিদেশের লোকজন বাংলাদেশকে চিনত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবেই। দেশে এখনও ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন হয়; কিন্তু সেই আমরা বাংলাদেশিরাই এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পুরো বিশ্বের কাছে এক আশ্চর্যের নাম!

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পৃথিবীতে একদম সেরাদের কাতারে বাংলাদেশের নাম। যুক্তরাষ্ট্রে যখন হ্যারিকেন ‘ক্যাটরিন’ আঘাত হানল; তখন দেশটির সরকার পর্যন্ত বলেছিল, বাংলাদেশের কাছ থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে! ধনী দেশ না হয়েও কীভাবে আমরা এত চমৎকারভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করি; এটা জানার জন্য শুনেছি আমেরিকান বিশেষজ্ঞ দলও নাকি বাংলাদেশ সফর করেছে।

ক্যাটরিনার আঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের উপদ্রুত এলাকায় অনেক চুরিডাকাতির খবর পাওয়া গেছে! মনে আছে, সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর সাধারণ মানুষ কীভাবে সেখানে ছুটে গিয়েছিল! নিজেদের জীবন বাজি রেখে লোকজন উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। না, কেউ সেখানে চুরি-ডাকাতি করতে যায়নি। গরিব এই দেশের মানুষজন কিন্তু ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল।

দেশে এখন বন্যা হচ্ছে। খেয়াল করে দেখবেন, অনেক সাধারণ মানুষ দুর্গতদের সাহায্যের জন্য ছুটছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত।

বর্তমানে জঙ্গিবাদ কিছুটা সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বাস করি, একটা সময় আমরা জঙ্গি হামলা মোকাবিলায়ও পৃথিবীর কাছে ‘রোল মডেল’ হব। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের চরমপন্থাকে সবসময় ঘৃণা করে এসেছে; প্রত্যাখ্যান করেছে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক মানসিকতাও। আর এসব আদর্শের কারণেই কিন্তু আমরা স্বাধীন একটা দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিয়েছি।

সম্প্রতি অলিম্পিকের পর্দা উঠেছে ব্রাজিলে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গলফার সিদ্দিকুরের হাতে বাংলাদেশের পতাকা ছিল। ছোট্ট বাংলাদেশি দলটার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। নিজ দেশের পতাকা হাতে স্টেডিয়ামের ভেতরে সিদ্দিকুর হেঁটে যাচ্ছেন– এই দৃশ্য দেখে, ধারণা করি, আমার মতো অনেকেরই চোখ ঝাপসা হয়েছিল সেদিন!

বাংলাদেশ হয়তো অলিম্পিকে তেমন কোনো সাফল্য পাবে না। তবে আমি জানি, ‘আবেগ’ নামের কোনো ইভেন্ট যদি অলিম্পিকে থাকত; সেই ইভেন্টে আর কোনো দেশ নয়, বাংলাদেশই স্বর্ণপদক পেত! এই যে ফোর্বস আর ওয়াশিংটন পোস্ট বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেদন করেছে– এর কারণ আর কিছু নয়; আমাদের আবেগ আর দেশের প্রতি ভালোবাসা।

আর এ দুই ‘অমূল্য’ পুঁজি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্র:
https://www.washingtonpost.com/opinions/when-it-comes-to-female-leadership-bangladesh-is-way-ahead-of-the-united-states/2016/08/04/03049850-58e3-11e6-8b48-0cb344221131_story.html?utm_term=.3cb3944299e3
http://www.forbes.com/forbes/welcome/#2d500e4b1319