যাঁরা সেদিনের এই আনন্দ আয়োজনে এসেছিলেন তাঁরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মেজবানের অভিজ্ঞতায় নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছেন। ফিরে গেছেন একরাশ আনন্দের স্মৃতি নিয়ে। সবাই এতটাই অভিভূত হয়েছেন এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজনে যে, তাঁরা প্রতি বছর এই মেজবান আয়োজনের আবদার করেছেন আয়োজকদের কাছে। যাঁরা ব্যক্তিগত কারণে বা নিতান্তই অবহেলা করে আসেননি, তাঁরা অনেকেই ফেসবুকে ছবি আর লাইভ দেখে আফসোস করে বলেছেন, আহারে, কি মিসটা করলাম! হায় আল্লাহ, তোমারা এত মজা করলা? আগামী বছর ঠিক আইমু।
আসলেই না আসলে এই অভিজ্ঞতা বলা সম্ভব নয়। আমরা যাঁরা মেজবানে গিয়েছি…সবাই অন্তর থেকে অনুভব করেছি, মেজবান একটি চমৎকার ঐতিহ্যবাহী সহভাগিতার আনন্দ আয়োজন।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সকাল ৭টায় পার্কে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন আয়োজকেরা সমস্ত আয়োজন নিয়ে। ফেসবুকের পাতায় এসে গেল, মেজবান অন…শুরু হয়ে গেল রান্নার আয়োজন। এক হাজার লোকের রান্না, এটা চাট্টিখানি কথা নয়। কোনো রেস্টুরেন্ট বা হোটেল নয়, কোনো প্রফেশনাল কুক বা শেফ নেই। তারপরও এক অদম্য আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে আয়োজকেরা শুরু করে দিয়েছেন রান্নার পালা, খোলা আকাশের নিচে।
আকাশ সকালের দিকে একটু মেঘলা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আবহাওয়ার বিষণ্নতা কাটিয়ে চারদিকে ঝলমল করে উঠল রোদেলা দুপুর। আয়োজকেরা হাসিমুখে রান্নায় ব্যস্ত। ৫-৬টি পোর্টেবল গ্যাসের চুলায় বসানো বিরাট রান্নার হান্ডি থেকে উড়ছে ধোঁয়া। মসলা মাখানো লাল ঝোলে টগবগ করে ফুটছে মাংস। কাছে আসতেই বাতাসে ভর করে এল সুস্বাদু রান্নার সুঘ্রাণ। এই সুঘ্রাণ থেকেই আন্দাজ হয়ে গিয়েছিল রান্না চমৎকার হচ্ছে। হইচই করে আনন্দ অনুভবে চলতে থাকল রান্নার পালা। রেদোয়ান চৌধুরী, মাহ্সাদুল আলম (রূপম), রাজিব বড়ুয়া, সঞ্জয় বড়ুয়া, সেলিম আক্তার, জীবক বড়ুয়া, প্রণব বড়ুয়া, আব্দুল মান্নান ও ফয়েজ আহমেদসহ আরও বেশ কয়েকজন মিলে ব্যস্ত তখন এই সুস্বাদু রান্নায়।
রেদোয়ান চৌধুরীর নেতৃত্বে এই রান্না চলছিল। থেকে থেকে তিনি মসলা দিচ্ছিলেন ও সবাইকে গাইড করছিলেন। পেশাগত রান্নার প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছাড়া এত বড় রান্নায় মসলার আন্দাজ কি করে করছেন, তাই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে তা পরিচালনা করছিলেন রেদোয়ান চৌধুরী, সত্যিই অবাক হয়েছি।
মাঝে মেঝে চলছিল রান্নার টেস্টিং…কেমন হচ্ছে, লবণ-মসলা সব ঠিক আছে কিনা, মাংস কতটুকু নরম হয়েছে ইত্যাদি। সবাই যখন টেস্টিং করছিল…শুধু একটি আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল—উঁহু…মাই গড, সো টেস্টি। উমমম…উমমম! যাঁরা ঝাল একটু কম খান, তারা বলে উঠলেন, খাইছে আমারে…কি ঝাল হইছেরে! মুখ জালাই ফালাইছি! অন্যেরা সঙ্গে সঙ্গে একটুন ঝাল না অইলে কি ভাল লাগবনি?…ভাতের লগে কিছুটা কমি যাইব।
সত্যিই আনন্দদায়ক ও চমৎকার ছিল সে টেস্টিং পর্ব। ক্লিক ক্লিক করে বেশ কিছু ছবিও উঠে এল টেস্টিংয়ের। স্বাভাবিক কিন্তু ভিন্নরকম মুখভঙ্গিতে…মাংসে কামড়রত অবস্থায়।
ধীরে ধীরে অতিথিদের আসা শুরু হয়ে গেল। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতার মাঝেই চলতে থাকল রান্নার শেষ পর্ব। রান্না শেষ হতে হতে ইতিমধ্যে ভরে গেল পার্কের চত্বর। শেডের ভেতর-বাইরে তখন অনেক লোক। অডিটোরিয়ামে চলতে লাগল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। চারপাশে চলতে থাকে মানুষের আলাপচারিতা…গল্পগুজব আর প্রাণখোলা হাসির শব্দ এবং ছবি তোলার পালা, সেলফির পালা।
অতঃপর সেই বহুল প্রতীক্ষিত বিশেষ মেজবানি রান্নার মধ্যাহ্ন ভোজ। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই খাবার নিয়ে বসে গেল। কেউবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অব্যাহত রাখল তাদের আড্ডা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এখানে যেহেতু ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আমন্ত্রিত ছিলেন, তাই সবার ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আয়োজনে গরুর মাংসের পাশাপাশি খাসি ও মুরগির মাংস এবং চানার ডাল রাখা হয়েছিল। সবার মুখেই চমৎকার রান্না ও আয়োজনের প্রশংসা।
সবাই অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে বিশেষ মেজবানি রান্নায় মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিলেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল শেডের ভেতরে মঞ্চে চট্টগ্রামের গানের ছন্দে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন; সন্তোষ বড়ুয়া, অসীম বড়ুয়া, জুয়েল বড়ুয়া, সীমা খান, আবু রুমী, নাসের চৌধুরী, সুদীপ্তা বড়ুয়া, বনানী বড়ুয়া, সঞ্জয় বড়ুয়া, নিভা বড়ুয়া, লাকী বড়ুয়া, অদিতি বড়ুয়া, রবি রায়হান, তসলিম আহমদ, রিপু বড়ুয়া, মুক্তা বড়ুয়া, সুমী চৌধুরী ও নাসরিন প্রমুখ। তবলায় ছিলেন আশিস বড়ুয়া, একর্ডিয়ানে আবু রুমী ও বাঁশিতে মোহাম্মদ মজিদ।
উপস্থাপনা করেছেন ওয়াশিংটনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ, সবার পরিচিত ই-লার্নিং শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবক ড. বদরুল হুদা খান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সবার পরিচিত প্রিয় ছড়াকার সন্তোষ বড়ুয়া। তাদের দুজনের অত্যন্ত চমৎকার ও প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় পুরো অনুষ্ঠানই যেন প্রাণ পেয়েছিল। আর বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আয়োজনের সাজুয্যে পুরো অনুষ্ঠানে শুধুই চাটগাঁইয়া ভাষায় উপস্থাপনা করা হয়েছে। যা ছিল খুবই হাস্যরসাত্মক ও চমকপ্রদ। সবাই অন্তর দিয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। এ ছাড়া ছিল র্যাফল ড্রয়ের ফলাফল ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ। এই পর্বও চাটগাঁইয়া ভাষায় উপস্থাপন করে বদরুল হুদা খান সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। অনেক হাসি আনন্দের মধ্য দিয়ে এ পর্ব সম্পন্ন করা হয়।
পড়ন্ত বিকেলে অনুষ্ঠান শেষে আগামী বছরে মেজবানের প্রত্যাশা রেখে সবাই একে একে বিদায় নিয়ে চলে যান পার্কের সবুজ চত্বর ছেড়ে। পেছনে রয়ে যায় আয়োজকেরা। তাঁদের সমস্ত কিছু সম্পন্ন করে দায়িত্ব পূর্ণ করে যেতে হবে। সব কাজ শেষ করে সব শেষে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ান আয়োজকেরা। সবাই ক্লান্ত। ফিরে গিয়ে একটু বিশ্রামের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ। কিন্তু দেওয়ার আনন্দে, সহভাগিতার অনুভবে এক পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি ছেয়ে আছে তাঁদের মন জুড়ে।
বাড়ি ফেরার পথে ড্রাইভ করতে করতে ভাবছিলাম, আমরা বেশির ভাগ সময় মানসিকভাবে কতটা ক্ষুদ্র বৃত্তে বিচরণ করি! পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ সব সময় অন্যের কাছ থেকে পেয়ে আনন্দ পেতে অভ্যস্ত, কিন্তু অন্যকে দিতে পারার যে নির্মল আনন্দ, তা হয়তো পাওয়ার আনন্দের চাইতে বহু গুন বেশি এবং তা অনুভব করার জন্য বড় মন প্রয়োজন। প্রয়োজন আকাশজোড়া মানসভূমির বিশাল ব্যাপ্তি!
যাঁরা এই মেজবান আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বা উদ্যোক্তা তারা হলেন; রেদোয়ান চৌধুরী, সঞ্জয় বড়ুয়া, প্রণব বড়ুয়া, মাহ্সাদুল আলম (রূপম), জীবক বড়ুয়া, অসীম বড়ুয়া, রাজিব বড়ুয়া ও সরোজ বড়ুয়াসহ তাদের আরও কিছু বন্ধুবান্ধব।
ছবি কৃতজ্ঞতা: রাজিব বড়ুয়া, বিপ্লব দত্ত ও এ্যন্থনী পিউস গমেজ।