ইতিহাস-ঐতিহ্য

মার্কিন মুল্লুকে বাংলাদেশের বীরত্বের ইতিহাস

kjfজীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে দেশ থেকে দূর পরবাসী আমরা। আর তাই বিদেশ বিভুঁইয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের সন্তানদের কাছে অনেকটাই অজানা বাংলাদেশের বীরত্বের ইতিহাস ও সময়ের বিপরীতে হেঁটে জয় ছিনিয়ে আনার গল্প। গৌরবের ইতিহাস প্রবাসে বেড়ে ওঠা আমাদের সন্তানদের কাছে পোঁছাতে ও ছেলে-বুড়ো সবাইকে এক আড্ডায় শামিল করতে মার্কিন মুল্লুকে গঠিত হয়েছে এক সংগঠন। গতানুগতিক অন্য সংগঠন থেকে কিছুটা আলাদা এ সংগঠনের পথচলা। বর্ণ নামের গড়ে ওঠা অলাভজনক এই সংগঠনটি ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের রচেস্টার শহরে নিবন্ধিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও বাঙালির সংস্কৃতি বিদেশ বিভুঁইয়ে বসবাসকারী প্রবাসীদের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরাই এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশেষ দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে বর্ণ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বিশেষ সিনেমা প্রদর্শনী, প্রামাণ্যচিত্র, কবিতা আবৃতি ও স্বরচিত কবিতা পাঠের আয়োজন করবে বলে জানালেন সংগঠনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ফয়যুল মোমেন ফয়েজ।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বর্ণ প্রচার করতে যাচ্ছে ১৯৭১ সালে বাল্টিমোরে সচেতন জনসাধারণের প্রতিবাদের ওপর নির্মিত ব্লকেড নামের প্রামাণ্যচিত্র। একাত্তরে যখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতা করছিল তখন সাধারণ নাগরিক পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি নিকটবর্তী বাল্টিমোর শহরের পোর্টে জমায়েত হয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। পোর্টে অবস্থানরত সচেতন আমেরিকানরা পদ্মা নামের সমরাস্ত্রবাহী জাহাজটির চারপাশে অবস্থান নেন। জীবন বাজী রেখে প্রতিবাদকারীরা ছোট ছোট নৌকায় জাহাজটি ঘেরাও করেন। প্রামাণ্যচিত্রতে সেই সময়ের দুর্লভ কিছু ভিডিওচিত্র, স্থিরচিত্র ও প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতিকথা ধারণ করেছেন পরিচালক আরিফ ইউসুফ ও তাসবির ইমাম সাক্ষর। রিচার্ড টেইলরের লেখা বই অবলম্বনে এ নির্মাণ। মিশিগানের রচেস্টার পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে ২৩ এপ্রিল প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচার করা হবে।
ইতিপূর্বে বর্ণ মিশিগানের রচেস্টার শহরের পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে আয়োজন করে চলচ্চিত্র ও কবিতা বিকেল | অনেকটা পরীক্ষামূলক প্রথম আয়োজন ছিল এটি। একাত্তরের যুদ্ধ-শিশুদের নিয়ে শামিম শহীদের নির্মিত শর্টফিল্ম Angels of Hell দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানটি | পেশায় প্রকৌশলী শামিম শহীদের এটি প্রথম শর্টফিল্ম। নির্মাতার নিজের ভাষায়: ছবিটি মূলত মানবতা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধানুভূতির একটি কাহিনি। প্রায় পঁচিশ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটি উপস্থিত সব দর্শকের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়, বিশেষ করে দুজন যুদ্ধশিশু, যারা এখন বড় হয়ে স্ব-স্ব স্থানে অধিষ্ঠিত, তাদের সাক্ষাৎকারের মুহূর্তগুলো ছিল খুবই মর্মস্পর্শী। ছবিটি ইতিমধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার যেমন পেয়েছে, তেমনি দেশ-বিদেশ—কানাডা, ফ্রান্স, ভারত, ইতালি, আর্মেনিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকার নামকরা অনেক ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনের আমন্ত্রণও পেয়েছে |
শর্টফিল্মটির প্রদর্শন শেষ হলে শামিম শহীদ নিজের কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শোনান দর্শকদের। পাশাপাশি জানান তার কিছু ভবিষ্যত পরিকল্পনা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে। চা-নাশতার বিরতি দিয়ে এরপর শুরু হয় অনুষ্ঠানটির কবিতা পাঠ পর্ব; রাহাত খানের স্বরচিত কবিতা দিয়ে শুরু হওয়া পর্বটিতে অংশ নেন আসিফ সালাহউদ্দিন, শফিক ইসলাম, জাকিরুল হক টুকু, আহমেদ জামি খান ও ফেরদৌস গাজী। বহুদিন পর বাংলা কবিতার এই ছন্দ-মাধুরী দর্শক-শ্রোতা মনে সুন্দর দাগ কেটে যায়।
বাংলাদেশি প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল নির্মিত নিঃসঙ্গ সারথি প্রামাণ্যচিত্রটি দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠানটি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জীবনীভিত্তিক এই ছবিটি প্রযোজনা করেছেন তারই মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি, যিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বর্তমান সংসদের একজন সম্মানিত সংসদ সদস্য। প্রায় এক শ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রটিতে উঠে এসেছে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম এবং তৎপরবর্তী পঁচাত্তর অবধি বাংলাদেশের ইতিহাস | অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী তাজউদ্দীন আহমদের সহজ সরল জীবনের নানা ধাপ, তার সততা, একনিষ্ঠতা আর বিশেষ করে একাত্তরে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সবকিছু খুব স্বচ্ছন্দ-সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে ছবিটিতে। যা উপস্থিত দর্শকদের গভীরভাবে আপ্লুত করে।
প্রয়াত শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামি (শহীদ শাফী ইমাম রুমীর ছোট ভাই) অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তার আনন্দের কথা ব্যক্ত করেন আর আয়োজকদের বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে আগত একজন নারী দর্শক তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, বারবার আমার দুই ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল; তারা তখন বয়সে যুবক, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের শত্রুরা একদিন তাদের ধরে নিয়ে যায়, পরে অনেক কষ্টে ছাড়াতে হয় তাদের।
আবেগে আপ্লুত এক প্রবীণ অতিথি জানান, সবকিছু তো আসলে নিজের চোখ দিয়ে দেখা, মনে হচ্ছিল সেই সময়টায় যেন আবার ফিরে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান চলাকালে একটি প্রামাণ্যচিত্রে যখন পূর্ব দিগন্তে-সূর্য উঠেছে-রক্ত লাল গানটির সুর ভেসে ওঠে, তখন কয়েকজন মধ্যবয়সী দর্শক স্বকন্ঠেই গেয়ে ওঠেন গানটি। দুই বাংলার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো দর্শক অনেকটা পিনপতন মনযোগ দিয়ে উপভোগ করেন অনুষ্ঠানটি। তারা এমন অনুষ্ঠান যেন আরও দেখতে পান ভবিষ্যতে তার আশা প্রকাশ করেন অনুষ্ঠান শেষে।
ব্যতিক্রমধর্মী এ নান্দনিক অনুষ্ঠানটি আয়োজনের নেপথ্যে ছিলেন আহমেদ জামি খান, ইমরান হোসাইন, জিয়া হক, সালাহউদ্দিন আজিজ, আবু আশরাফ, শাহরিয়ার আহমেদ, রাহাত খান, শামিম শহীদ ও ফয়যুল মোমেন ফয়েজ। আগত অতিথিদের বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বাঙালি মন-মানসের সংগ্রামী ও অদম্য সংস্কৃতি আরও বেশি করে তুলে ধরার আগ্রহ ব্যক্ত করেন ফয়যুল মোমেন ফয়েজ।
বর্ণ সংগঠনটির প্রথম আয়োজন সফল হওয়ায় আয়োজকেরা বেশ আশাবাদী। ভবিষ্যতেও তারা সকলের অংশগ্রহণ ও সমর্থন আশা করেন।