বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-নদীর ওপার কহে/ ছাড়িয়া নিশ্বাস/ ওপারেতে সর্বসুখ/ আমার বিশ্বাস…। মেরিল্যান্ড আর ভার্জিনিয়া ঘুরে এসে সেই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল। আমরা নিউইয়র্কে থাকি, জ্যাকসন হাইটস থেকে এসেছি শুনে তাদের সেকি কৌতূহল! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কত প্রশ্ন। কারণ, আমরা এখানে সব পাই। বাংলাদেশের সব খাবারদাবার। বাংলাদেশের সব সেলিব্রেটি। বাংলা সংস্কৃতির সব ধরনের অনুষ্ঠান।
তারা থাকেন বিশাল প্রাসাদে। আমরা নিউইয়র্কবাসীরা যা দেখে মুগ্ধ হই। অগোচরে হয়তো দীর্ঘশ্বাসও ফেলি। চারদিকে দামি আসবাবপত্র। অ্যান্টিকস শোপিস। পুরো বাড়ি কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাইরের খররোদ বাড়ির মানুষদের প্রভাবিত করে না। তবু তাদের মনে বিষণ্নতা যেন কাটে না। একজনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি প্যানিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন বহুদিন। ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে সারা দিন ঘুমিয়ে কাটাতেন। অনেকটা পাগল হওয়ার অবস্থা। তার মনের সারাক্ষণ আতঙ্ক আর কোনো দিন বাংলাদেশে যেতে পারবেন না।
নিউইয়র্কেও বহু মানুষ আছেন, যারা জানেন না কবে বাংলাদেশে ফিরবেন? কবে তারা লিগ্যাল হবেন? অনেকে পরিবারবিহীন অবস্থাতেও এখানে ২০-৩০ বছর, এমনকি সারা জীবন কাটিয়ে দেন। তবু তাদের মনে এতটা বিষণ্নতা ভর করে না। কারণ এখানে বাংলাদেশের সবকিছু তিনি পেয়ে যান।
মেরিল্যান্ড-ভার্জিনিয়ার চিত্রটা বোস্টন-কানেকটিকাটেও। গত ঈদের ছুটিতে সেখানে গিয়ে আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হয়তো ফ্লোরিডা, হিউস্টন, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, আটলান্টাতেও চিত্রটা মোটামুটি একইরকম। এই শহরগুলিতে আমার যাওয়া হয়নি। নিউইয়র্ক বাদে এই সব শহরেও অনেক বাঙালি থাকেন। তারা বাংলা সংস্কৃতিকে হৃদয় ধারণ করেন। নববর্ষ ও ঈদে বাড়ি ও ক্লাবে অনেক আয়োজন থাকে। কিন্তু অনুষ্ঠানের সময়টুকু বাদ দিলে তারা একা, নিঃসঙ্গ।
নিউইয়র্কের মতো সেখানে পথে পথে হাঁটার সুযোগ নেই। হঠাৎ বহুদিন আগে পরিচিত কেউ কাঁধে হাত দিয়ে বলে ওঠে না, আরে তুমি? কোথায় আছ? কেমন আছ? এখানকার বাঙালি দোকানে যেভাবে কলাটা-মুলাটা, কচু-এচোড় পাওয়া যায়, সেটা আর কোথায় মিলবে? এখানে বেশির ভাগ মানুষ ছোট এক বেডরুমের ফ্ল্যাটে থাকে। তবে সেই বাড়ি ভরে ওঠে প্রাণের উষ্ণতায়।
উদীচী, শিল্পকলা একাডেমি, বাফা, আনন্দধ্বনি, নজরুল একাডেমি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন-বাংলাদেশের সব শীর্ষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের শাখা আছে নিউইয়র্কে। বাংলাদেশের মতোই তাদের অনেক কার্যক্রম। এর বাইরে আরও আছে বিপা, সংগীত পরিষদ, সাহিত্য একাডেমি, বহুবচন, গাঙচিল, হিন্দোল, স্পোর্টস ফাউন্ডেশন অব নর্থ আমেরিকাসহ আরও বহু বহু সংগঠন। আছে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় সমিতি। রাজনৈতিক সংগঠন আছে। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আছে। এসব সংগঠনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও ইতিবাচক দিকগুলোই বেশি। মানুষ এখানে নিজের মানসিকতার লোকজনকে পায়, নিজের অঞ্চলের, নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানুষগুলোকে পায়। আর এই পাওয়াটা যে কত মধুর, যে পায় সেই শুধু জানে!
অন্যান্য শহরে বাঙালিরা গানবাজনা করেন। তবে সেটা একইরকম। ব্যান্ড বাজিয়ে পেশাদার কিংবা অ্যামেচার শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো। অনেকগুলি পরিবার একত্র হয়ে ছোট-বড় আয়োজন থাকে। কিন্তু সেখানে নিউইয়র্কের মতো এত বৈচিত্র্য নেই। নিউইয়র্কের বাইরেও বিখ্যাত কোনো স্থানে বাঙালিরা বেড়াতে যান কিংবা থাকেন। কিন্তু মিডিয়ার সমস্ত ফোকাস তো এখানেই। কারণ সব বাংলা পত্রিকা, বাংলা টেলিভিশন তো নিউইয়র্কেই। যে জন্য আনিসুল হক এসে বলে গেলেন, নিউইয়র্ক আমার কাছে দ্বিতীয় ঢাকা। সেলিনা হোসেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, রামেন্দু মজুমদাররা অবাক হন, এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতির মান দেখে। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবদুল গাফফার চৌধুরীর বোমা ফাটানো কথাবার্তা-সব তো এই নিউইয়র্কেই।
নাগরিক নাট্যাঙ্গনের জনতার রঙ্গশালা কিংবা স্মৃতিসুধা নাটক দেখার পরে অনেকক্ষণ সময় লাগে বুঝতে যে আসলে ঢাকায় নাকি নিউইয়র্কে আছি। এত সমৃদ্ধ পরিবেশনা। বাংলাদেশের এক সময়ের সাড়া জাগানো নাট্যশিল্পীরা নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করছেন এখানে। কেউ কেউ বর্তমান প্রজন্মকে দীক্ষিত করছেন বাংলা সংস্কৃতিতে। বাফার চণ্ডালিকা কিংবা বিপার তাসের দেশ যে জন্য হয়ে ওঠে অত্যন্ত পেশাদার একটি পরিবেশনা।
আজ রুনা-সাবিনা, কাল শ্রীকান্ত, আগামী সপ্তাহে নচিকেতা, আগামী মাসে বাপ্পা মজুমদার কিংবা জেমস-এসব কি নিউইয়র্কের বাইরে অন্য শহরে মিলবে। মিলবে না? ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড-বাংলা সিনে অ্যাওয়ার্ডে অংশ নিতে আসেন বাংলাদেশের সব টপ সেলিব্রেটি। দেশসেরা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সেমিনারও হয়। নিউইয়র্কের দর্শকদের উইকএন্ডে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। পুরুষেরা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর নারীরা শাড়ি-চুড়ি পরে, কপালে টিপ দিয়ে হাজির হয়ে যান সব আয়োজনে।
এই যে ঈদের আগের দিন চানরাতে নিউইয়র্কের পথে পথে যে আনন্দ, সেটা কি অন্য কোনো রাজ্যে বা শহরে পাওয়া যাবে। যাবে না! জ্যাকসন হাইটসের ৩৭ নম্বর অ্যাভিনিউর ৭২, ৭৩ ও ৭৪ স্ট্রিটে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে পথে ঘুরেও গাড়ি পার্কিং করতে পারেন না অনেকে। মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানগুলো ক্রেতা-বিক্রেতার দর-কষাকষিতে থাকে মুখর। শুধু বাংলাদেশি, পাকিস্তানি কিংবা ভারতীয়রা নয়, স্প্যানিশভাষী হিসপ্যানিকেরাও ফুটপাতেও সওদা সাজিয়ে বসেন। নারীরা মেহেদির আলপনায় রাঙিয়ে নেন দুই হাত। ৫ বা ১০ ডলার করে নেওয়া হচ্ছে আলপনা আঁকার জন্য। আবার কেউ বিনা মূল্যেও আয়োজন করেন। যেমন করেছিল ব্রংকসে বাংলাদেশ আমেরিকান উইমেন অ্যাসোসিয়েশন।
সব রাজ্যেই বসবাসরত বাঙালিরা আনন্দ করে-উৎসব করেন। তবে সবার আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গি একইরকম। শুধু নিউইয়র্কের আলাদা। যেন বাংলাদেশের মতো। এ জন্যই তো কষ্ট করে, গাদাগাদি করে হলেও এই শহরেই থাকতে ভালোবাসে বাঙালি।