বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও গবেষণায় চীন কত দূর চলে গেছে, সেটা অভাবনীয়। সারা পৃথিবীজুড়ে চীনের ছেলেমেয়ে। সে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শত্রুর নাম জাপান। অথচ জাপানেও গবেষণা করছে চীনের অনেক শিক্ষার্থী। গোটা দুনিয়া থেকে যে জাতিটা শিখছে, সেটার নাম চীন। তাদের অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য।
চীন তাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সে জন্য আছে বহু প্রকল্প। এর মধ্যে জনপ্রিয় একটির নাম সহস্র মেধাবী প্রকল্প (Thousand Talents Plan)। প্রতি বছর নানান শাখায় তরুণ গবেষককে স্বতন্ত্র গবেষণা (Individual Research) শুরুর জন্য অর্থ দেয় সরকার। কাজের সুযোগ করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায়। বিদেশে গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হয় কয়েক বছর। চরম প্রতিযোগিতা হয় সেখানে। বেরিয়ে আসে অসম্ভব মেধাবী সব তরুণ গবেষক। আমার একাধিক চীনা সহকর্মী, ওই প্রকল্পের অধীনে দেশে ফিরে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। চীন দেশে শুধু গবেষণার কৃতিত্বের ওপর ভিত্তি করে সরাসরি সহযোগী বা পূর্ণ অধ্যাপক হওয়া যায়। আমার দেশে অবশ্য বয়সভিত্তিক পদোন্নতি পাওয়া যায়।
এই যে, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে, তাতে দেশটা বদলে যাচ্ছে রাতারাতি। বিশ বছরে তৈরি হয়ে যায় কুড়ি হাজার জাঁদরেল গবেষক। কেউ কাজ করছেন সড়ক নিয়ে, কেউ ওষুধ নিয়ে, কেউ টেক্সটাইল নিয়ে, কেউ খাদ্য নিয়ে, কেউ গণমাধ্যম নিয়ে। এমন বহু ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নিজস্ব সম্পদ। ওই দেশের সকল গবেষকই যে দেশে ফিরে যাচ্ছেন তা নয়। কঠোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যদি দশ ভাগ ছেলেমেয়েই ফিরে যায় তাহলেই যথেষ্ট।
এই কাজটা শুধু চীন নয়, পৃথিবীর বহু দেশ করে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও সে দেশের তরুণদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ করে। ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পিএইচডি-পোস্ট ডক ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। অন্তত বিজ্ঞান অনুষদে মোটেও না। গবেষণায় সফল তরুণেরা বিদেশ থেকে সেখানে গিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সরকার তাদের গবেষণার জন্য আর্থিক সহযোগিতা করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো মাস্টার্স করেই শিক্ষক হওয়া যায়। কখনো কখনো স্নাতক করেই সম্ভব। এটা খুবই দুঃখজনক। এতে করে দেশে ফেরার জন্য বিমুখ হন বহু তরুণ।
পৃথিবীজুড়ে আমাদের ছেলেমেয়েও একেবারে নগণ্য নয়। আমাদের তরুণদের ফিরিয়ে নেওয়ার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কি? ফি বছর শুধু গরিব দেশ, গরিব দেশ বলে আসলেও, দেশে কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। চুরি হচ্ছে। গবেষণার জন্যও টাকা দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে-জবাবদিহিতা ছাড়াই। বিদেশে থেকে মেধাবীদের ফিরিয়ে নেওয়ার সঠিক উদ্যোগ নিলে বহু ছেলেমেয়ে ফিরে যাবেন। তাদের প্রাপ্য সুযোগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। তারা তাদের অভিজ্ঞতা, তারুণ্য ও একাগ্রতাকে কাজে লাগাবেন। রাষ্ট্র যদি এমন কাজটি শুরু করে তাহলে আগামী ত্রিশ বছরে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও গবেষণায় আমাদের স্বনির্ভরতা অনেক বাড়বে। রাষ্ট্রের সামান্য সৎ উদ্দেশ্য থাকলেই এটা সম্ভব। ভালো করেই সম্ভব। সেটা কি হবে কখনো?
ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]