প্রবাস জীবন

যে রাতে মোর দুয়ার ভাঙল ঝড়ে

লেখিকা
লেখিকা

লেখিকা

আমাদের সমস্ত ঘর নির্জীব হয়ে আছে। গ্রামীণ ভাষায় পুকুরে পড়ে আছে। যেন তেত্রিশ নম্বরের একটা শ্মশানঘাট। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছি। সঙ্গে আমার যমজ বোনটাও। রিমা–রিপা ফেল করেছে? ফেল?

পাড়ার মানুষগুলো বলল এই মেয়ে সেই মেয়ে না, যে ক্লাস এইটেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল? হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। রূপবতী একটা মেয়ের। রূপই তার কাল হয়েছিল। পরীক্ষা দিতে আসার পথেই প্রেমিক নামের পাষণ্ড তার হাতের রগ কেটে দিয়েছিল। সেই মেয়েটি; সেই রক্তাক্ত মেয়েটির বাকি পরীক্ষাগুলো আমিই দিয়েছিলাম, অনুলেখক হয়ে।
সেই আমি ফেল! আমার বাকি বোনগুলো নির্বাক। পরের দিন তাদের বান্ধবীদের কি বলবে তারা? আম্মু-আব্বু শীতল। কিছু সময় থাকে শীতলতায় অসংখ্য কথা। আম্মু-আব্বু আমাদের বকুক। বকেঝকে সব ঝড় শেষ হোক। ঝড়ের আগের এই গুমোট সময় তো সহ্য হয় না আর।
নাহ, আব্বু–আম্মু এর কিছুই করছেন না।
আম্মু–ভাত খাইয়ে দিলেন, যেমন করে পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে দিতেন। তবে কী কিছু পরিবর্তিত হয়নি? কেউ তো কিছুই বলছেন না। তবে যে জীবনে প্রথমবারের মতো হেরে যাওয়া দুটি মেয়ের পৃথিবী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। তাদের হিমালয়ের মতো আত্মবিশ্বাস মাটিতে মিশে অবয়ব হারাচ্ছে।
আব্বু সেদিন সন্ধ্যারাতে বাইরে গেলেন।
দুঃখের থেকে দায়িত্ব বড়। আব্বু বংশের সব থেকে বড়। সব ঝড় নাকি আগে বড় গাছের ডগায় লাগে। ঘরে দুটা মেয়ে ফেল করেছে তাদের রেখে আব্বু গেছেন, আমার এক কাজিন পালিয়েছে অন্যের মেয়ে নিয়ে, সেই সালিসে। মেয়ের বাবা কিছুতেই মানতে চাইছেন না; প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি এখন শুধু তার মেয়ে নয়, আরকজনের বৈধ স্ত্রী।
আমাদের ঘরে সেদিন সব থেকে ক্রিয়াশীল আমাদের বুয়া। তার তো শিক্ষা নেই, তবে কেন বুয়া এমন কষ্ট পাচ্ছে? আমরা রাত জেগে পড়তাম। বুয়া আমাদের জন্য চা করে দিত। তবে কি সেই চা করে বুয়া আনন্দ পেত? আহারে, মানুষ যে কত অদ্ভুত। অথচ এই চা করা নিয়ে আমাদের সঙ্গে বুয়ার খুনসুটি। প্রতিদিনই বলত, মণি আপুরা চা এত বেশি খাইয়েন না, কালা হই যাইবেন কইলাম!
আমাদের চারপাশে আজ যে কালো মেঘের আস্ফালন। পৃথিবীর কোনো সান্ত্বনাই স্থির করতে পারছিল না।
ভাইয়া তখন চট্টগ্রামে, সাংবাদিকতা পেশায়। পত্রিকাতে লেখে। তবে কেন আমাদের নিয়ে লেখে না? আমরা তো তার বোন। এই নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে আমাদের আড়ি। চাইলেই সব লেখা যায় না, এই জ্ঞান তো তখন ছিল না। নাইন-টেনের জ্ঞান আর কতই বা থাকে। ভাইয়া সেই ঝড়ের রাতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বাঁধ ভাঙা আনন্দ শিরোনামের নিউজ জমা দিয়ে বাসায় এসে তুমুল কেঁদেছে, তুমুল। তার খুব ইচ্ছে ছিল; তার টুইন বোনদের সাফল্য পত্রিকায় লিখে চমকে দেবে বোনগুলোকে। নাহ তা আর পারল কই।
সেই ঝড়ের রাতে আমাদের রেজাল্ট শুনে আমাদের আগে যিনি সবার আগে দিগ্ভ্রান্ত হলেন, ভয়ানক এলোমেলো হয়ে গেলেন, তিনি আমাদের প্রাইভেট শিক্ষক। আমরা যাকে মামা ডাকতাম। ভোর জাগার আগে তিনি জেগে যেতেন আমাদের পড়াবেন বলে। যিনি প্রতি শুক্রবারে পিকনিক করতেন, নিজে রান্না করতেন আমাদের পড়াশোনা যেন নিরানন্দ মনে না হয় সেই জন্যে। অথচ আমাদের রেজাল্ট খারাপ হলে সবার আগে তীর বিঁধল ওনার বুকে। কেউ কেউ বলছিলেন, নিশ্চয়ই এই মাস্টার ভুল অঙ্ক করিয়েছেন। নয়তো সব বিষয়ে এ প্লাস আর এ পেয়ে কেন তারা অঙ্কে ফেল করবে? উনি আসলে শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু পড়াতেন স্কুলে? উনি ছিলেন একজন অফিসার। নিজের অবসর সময়টা ভালোবেসে স্কুলকে দিয়েছিলেন, বিনা মূল্যে পড়িয়ে। আজ তিনি ভালোবাসার প্রতিদান পেলেন। আমরা ছোট মানুষ শুধু অনুভব করেছিলাম মামার বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। রেজাল্টের পরদিন মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত আমাদের একই প্রশ্নে তিনি আবার পরীক্ষা নিয়েছিলেন। দেখলেন, আশ্চর্য, কেটে কুটে হলেও তো ৭০ নম্বর পায় তাঁর বাঁশিরা। তিনি আমাদের বাঁশি ডাকতেন।
সেই বাঁশিদের করুন সময়ে হেড স্যার অঝোরে কাঁদলেন। চলতি পথে সাইকেল থামিয়ে আম্মুকে বলেছিলেন, আমার স্কুলের প্রথম বেঞ্চের প্রথম সারির মেয়েরা এমন রেজাল্ট করতে পারে না, আপা। আমি শিক্ষা বোর্ডকে চ্যালেঞ্জ করলাম। পুনঃ নিরীক্ষা হোক।
কিন্তু আমরা জানতাম। ভুল নয়, এটাই সঠিক।
আমরা ফেলই করেছি। সত্য এই। আসলে সবার এত পাহাড় সমান প্রত্যাশা আমরা নিতে পারছিলাম না। একটা অলিখিত প্রেশার ছিল। অপ্রত্যাশিত কত কী ঘটে মানুষের জীবনে। সব বিষয়ে তুমুল ভালো করেও অঙ্কে প্রশ্ন হাতে নিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমি সব ভুলে গেছি, সব। যমজদের সাইকোলজিকাল একটা কানেকশন থাকে। প্রখর নিরাপত্তা সত্ত্বেও রিপার চোখের দিকে তাকালাম সেই চোখে দেখলাম বিমর্ষতা। সেও। আমরা কিছু না লিখে ফিরে এলাম। এসেই ঘুম। ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি।
সেই ঝড়ের রাতের পরের দিন। মেধাবী বলে কিছু নেই। পরিশ্রমই সাফল্যের সুখ কাঠি জানা আমরা পরিশ্রম করতাম ও পড়তাম বলে কোচিং ক্লাসে স্যার একবার উদাহরণ দিয়েছিলেন। সেই উদাহরণ হওয়া মেয়েগুলো আজ অন্যরকম এক উদাহরণ। তাদের দেখতে রহমতপুর স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী বাসায় এল। আমরা বিব্রত।
শুনতে পেলাম, আমাদের সব থেকে কাছের স্বজন, রোল নম্বরের তারতম্যের জন্য যে ক্লাসে বসত সব থেকে পেছনে সেই সব থেকে খুশি। আমাদের অন্য সব বন্ধু খুশি না হলেও দুঃখ পেল না। সঙ্গের প্রতিযোগী হারলে কেউ তা পায় না।
দেখতে পেলাম, যে ছেলেটার সঙ্গে কখনো কথা বলিনি, যে আমাদের বন্ধু নয়, সে এল। আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমাদের রাজহাঁস ছিল। রাজহাঁস ভয় পায় বলে যাকে আমরা গাধা বলে লজ্জা দিতাম, সেই লজ্জা পাওয়া ছেলেটা সেই রাজহাঁসকে ডিঙিয়ে তার সমস্ত লজ্জাকে পরাজিত করে আমাদের দেখতে এল। ছেলেটা সুদর্শন ছিল। এতই সুদর্শন ছিল যে, দেখলে মনে হতো সদ্য বাংলাদেশে আসা কোনো জার্মান! অথচ এই সুদর্শন ছেলেটার সৌন্দর্য সহ্য হলো না কারও। তাকে, তার সৌন্দর্যকে তার দুর্বলতা বানিয়ে দিল স্কুল বন্ধুরা। তাকে ভিন্ন একনামে ডাকত। না, সেই নাম বলতে আমি আসিনি। তাকে সে নামে একমাত্র আমরা দুই বোনই ডাকতাম না। আচ্ছা, সে কী তা জানত? তাই কী সে আজ এখানে, আমাদের সামনে? সেই ছেলে, সেই সুদর্শন ছেলে যার চোখে সেদিন আমরা দেখেছিলাম সত্যিকারের মমতা ও ভালোবাসা। সেদিন তার সামনেই আমাদের চোখ থেকে অঝোরে ঝরেছিল জল। আমাদের আর কোনো বন্ধুর সামনেই এমনটি ঝরেনি।
এই ঝড়ের রাত এত কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল।
সেই ঝড়ের দিনগুলোতে আমরা সব থেকে তির্যক মন্তব্য পেলাম কাছের সব থেকে শিক্ষিত একটা পরিবার থেকে। ব্যর্থতা এত কষ্ট দেয়নি, যতটা না দিয়েছেন তারা। চার বাক্যের একটা কথায়। সেটা বাক্য ছিল না, তীর ছিল। আমি সেদিন হতভম্বের মতো রিপার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রিপা আমার হাতটা বুকের কাছে নিল, নিজের কষ্টটা নিঃশব্দে লুকিয়ে বলল, পাখিকে আকাশে মরতে দেখি না। মানুষ বা পাখির পরাজয় এমনই। আকাশ জানে না আছি না গেছি!
আম্মু-আব্বু সেই ঝড়ের দিনগুলোতে একদম নিশ্চুপ ছিলেন। যেন কিছু হয়নি! আব্বু সপ্তাহ পর ডেকে একটা গল্প বললেন, জান, তোমাদের যে জজ চাচ্চু আছেন, উনি জীবনে এমন একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন।
সেই গল্প আমাদের ভেতরে আলোড়ন তুলে দিল। তাই তো, সব মানুষ এমন ধাক্কা খায়? যারা অনেক বড় তারাও? এরপর আমরা কখনোই আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। ঝড়ের একটা বছর বহু কিছু শিখেছি। সত্যিকারের স্বজন দেখেছি, আর অবসরে বই পড়েছি। বিখ্যাত মনীষীদের জীবন কাহিনি। খুব সাহস করে ওই বইয়ের নাম কেটে দিয়েছি। কাটব না? আরে এত দেখছি, বিখ্যাত মনীষীদের ফেলের কাহিনি।
ওমা, কী কাণ্ড, দেখি আলবার্ট আইনস্টাইনের পরীক্ষার ফল বেরোল। অঙ্কে অসামান্য কৃতিত্ব, এদিকে বায়োলজি আর সব বিষয়ে ফেল। আমরা শুধু অঙ্কে ফেল, আর সব বিষয়ে মস্ত পাস। সত্যকথন; সেই ফেলই আমাদের অন্যরকম এক বোধ দিয়েছে।
এরপর ঝড়ের একটা বছর পর।
আমরা সেই ভাঙা সাঁকো পার হয়ে এলাম। কৃতিত্বের সঙ্গে পাস। আম্মু-আব্বু সেদিন বললেন আর অঝোরে কাঁদলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, মারে আম্মু-আব্বু জানি, জানতাম তোমরা পারবে। আমরা এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। এসব বলতে বলতেই তাদের কণ্ঠ বেয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে কান্না। যেন একটা বছর গোপন রাখা একটা কষ্ট, একটা বিশ্বাসের সেদিন মুক্তি! সেই দিন জয়।
তখনই আমরা আমাদের সেই ব্যর্থতাকে সমৃদ্ধির ভিত্তিপ্রস্তর বানালাম।
এইচএসসিতেও তুমুল ভালো করলাম। অধ্যাপকেরা বললেন, যেখানে আর্টস মানে সবকিছু ঠিকঠাক লিখেও শিক্ষকদের অহেতুক কৃপণতা দশ মার্কের উপযুক্ত উত্তরেও নয় নম্বর দেয়। সেখানে আর্টস থেকে এ প্লাসের কাছাকাছি যাওয়া সহজ নয়।
আজ রিপা বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যে সাফল্যের সঙ্গে অনার্স মাস্টার্স শেষ করল। আমি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যালেন্সিয়া কলেজে ডেন্টাল হাইজিন মেজর নিয়ে পড়ছি। আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে আরও।
আমরা পেরেছিলাম। জেনেছিলাম গৌরবের আনন্দ সকলের। তাতে পৌঁছানোর জন্য যে সিঁড়ি তা থেকে পিছলে যাওয়ার ভয় কেবল একার। অধিকারী জানে কতটা পার হলে তা হয় সকলের। কতবার পড়লে উঠে দাঁড়ানো দেখা যায় দূর থেকে।
সেই ঝড়ের রাতে যদি আব্বু–আম্মুর সাপোর্ট না পেতাম, জীবনে কখনোই দুঃখ কি বুঝতে না পারা আমরা নিশ্চয়ই সেই দুঃখে তলিয়ে যেতাম। একদম অতলে তলিয়ে যেতাম এই কথা সত্য।
প্রকৃত অর্থে; জীবনে একটা ধাক্কা লাগে। হাঁটতে যাওয়ার প্রথম শর্ত পড়ে যাওয়া। ব্যস্ত নগরীতে চলতে গেলে ধাক্কা তুমি খাবেই, কিন্তু সেই ধাক্কায় পড়ে যাওয়াই শেষ কথা নয়, উঠে দাঁড়ানোটাই মূল। প্রত্যাশার চূড়া থেকে মুহূর্তেই কেউ পড়ে যেতে পারে পা ফসকে। প্রতিটা মা–বাবার উচিত হেরে যাওয়ার এই সময়েও তাদের সন্তানকে সঙ্গ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া, আস হাত ধরো। ওঠো। তুমি পার, তুমি পারবে!
আজ এত দিন পরও, যে ঝড়ের রাতে আমার দুয়ার ভেঙে ছিল আমি সেই দুয়ার আজও খুলে দিই। সে ভাঙা দুয়ার দিয়ে এখন আর শুধু লন্ডভন্ড করে দেওয়া বাতাস আসে না, গা জুড়ানো বাতাসও আসে। আমি আন্দোলিত হই। তাই ক্যাসেটের ভলিউম বাড়িয়ে দিই। বেজে ওঠে প্রিতমের স্বর, তুমি যখন যত্ন করে ঠোঁটে আঁকো রেড রোজ। আমি তখন হন্যে হয়ে করি টিউশনির খোঁজ। তোমার কষ্ট বড় জোর ওই দুল হারিয়ে ফেলা, তুমি কী আর বুঝবে মেয়ে স্বপ্ন পোড়ার জ্বালা!