মতামত

‘মনে রেখ আমিও ছিলাম’

tigerছবিটা দেখে এমনভাবে চমকে উঠলাম যেন বুকের মধ্যে কোথাও একটা শেল পড়ল। কী করুণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র-ভয়ংকর একটি বাঘ। কীভাবে আকুতি জানাচ্ছে সবাইকে! যেন বলতে চাইছে—মনে রেখ আমিও ছিলাম।
যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। যার শেষটুকু এমন, পুরো বন উজাড় হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে আর কেউ ডাকে না রয়াল বেঙ্গল টাইগার। কীভাবে ডাকবে? বনে তো কোনো বাঘ নেই!
এমন একটা আশঙ্কা অমূলক নয়। গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে বার্তা সংস্থা এপির এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ আছে ১০৬টি। এক বছর ধরে জঙ্গলের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন ক্যামেরায় বাঘের পায়ের ছাপ ধারণ করে তারা এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে। অথচ ২০০৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪০৪টি।
২০০৪ সালের পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিয়ে কিছু সন্দেহ আছে, কারণ সেটা করা হয়েছিল বাঘের থাবার ছাপ থেকে। তবু সংখ্যাটা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল ধরা যায়। পরিবেশবিদরা তাই আশঙ্কা করছেন, যেভাবে ক্রমহ্রাসমান হারে বাঘের সংখ্যা কমছে, ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
ইউনেসকো, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি থেকে শুরু করে পৃথিবীর তাবৎ সংগঠন যখন অস্তিত্ব সংকটময় প্রাণীদের রক্ষায় আদাজল খেয়ে নেমেছে, তখন বাংলাদেশ সরকার হাতে নিয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো আত্মবিনাশী এক পদক্ষেপ।
অনেক দিন ঝুলিয়ে রাখার পরে অবশেষে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে সরকার। সচেতন নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবাদীরা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোর বিরোধিতা করলেও সরকার এখন চাটুকারদের কথায় কান দিচ্ছে বেশি।

অনলাইনে পত্রিকা খুললে সুন্দরবন চুক্তির বিরুদ্ধে সংবাদ পড়ি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা জনে এই নিয়ে মতামত দিচ্ছেন। প্রতিদিন এই নিয়ে বিভিন্ন মহল ও সংগঠনের সভা, মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনের ওয়েবসাইটে নিয়মিত লেখালেখি হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তির বিরোধিতা করে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিকে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা বলেছেন, সুন্দরবন বিনাশী। এই চুক্তি নিয়ে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, সরকার একগুঁয়েমির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতীয় স্বার্থে এই চুক্তি সম্পাদন করেছে। আমরা এটা জেনেও এই চুক্তি বাতিল করতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে একজনও বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে না যিনি মনে করেন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। শুধু কমিশন এজেন্ট ও কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই দাবি করেন। তিনি আরও জানান, সরকার যদি মনে করে, তাদের দাবির পক্ষে বেশির ভাগ জনমত আছে, তাহলে গণভোট দিক। সরকার যদি মানুষকে প্রকৃতপক্ষে ভোট দিতে দেয়, তাহলে আমরা নিশ্চিত শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ এই চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন।
বিশ্বের কোনো নামকরা ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে এগিয়ে আসেনি। এসেছে শুধু ভারতের এক্সিম ব্যাংক।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে এ অঞ্চলের বনাঞ্চল, নদী, মানুষের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ, কৃষি, স্বাস্থ্য, মৎস্যসম্পদ, সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়বে। এই সবই উচ্চমানের গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত।
এই যে বৃক্ষ, বাঘ, হরিণ, বানর, ডলফিন এসবের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? তাদের বাদ দিয়ে কীসের উন্নয়ন। পৃথিবীর সেরা জীব হয়ে মানুষ কি শুধু নিজেদের কথা ভাববে! অবলা প্রাণীদের কথা ভাবার কি কোনো সময় নেই তাদের? আমরা সবাই বিদ্যুৎ​ চাই। উন্নয়ন চাই। কিন্তু জীববৈচিত্র্য ধ্বংস না করে, জীবনের মৃত্যু না ঘটিয়ে।
.বলতে পারেন, যে জনপদে মানুষ মরে নিত্যহীন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেখানে বিরাজমান, সেখানে একটা রয়াল বেঙ্গল টাইগারের জীবনের মূল্য কি? খাদ্যের অন্বেষণে আশপাশের গ্রাম থেকে আসা বাঘদের নিত্য পিটিয়ে মারে গ্রামবাসী। তার কি কোনো প্রতিকার হয়? হয় না। এসব ভেবে আর লাভ কি।
‘তোমরা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ক্যাঙারু ডেকো
নিউজিল্যান্ডারদের ডেকো কিউই
আমাদের আর বলো না
রয়াল বেঙ্গল টাইগার…’
জানি না, ভাবতেও চাই না. . কোনো দিন এমন সময় আসতে পারে!