জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের প্রস্থান

syed-shamsul-hoque2

 

জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক অমর হয়ে গেলেন।

ফুসফুসের ক‌্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার বিকালে চিকিৎসকরা তার মৃত‌্যু নিশ্চিত করেন। মৃত‌্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অমরত্বের ব‌্যাখ‌্যা দিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন, “সমকালীন বাংলা কবিতা ও বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এক সর্বাগ্রগণ্য কারুকৃৎ কবিশ্রেষ্ঠ সৈয়দ শামসুল হক এখন থেকে চিরজীবিত। “মানবশরীর নিয়ে আশি বছরের অধিককাল মর্ত্যবাসী থেকে এখন তিনি মহাবিশ্বের মহাকালের আদিঅন্তহীনতায় সমর্পিত। তাঁর সৃষ্টি অবিনাশী, তাঁর সত্তা অবিনাশী, তাঁর আলোক চির-সক্রিয় থাকবে বাঙালির মনে ও মননে।” সাহিত‌্যের সব ক্ষেত্রে সদর্প বিচরণকারী সৈয়দ হকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

সৈয়দ হকের মৃত‌্যুর খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সৈয়দ হকের শোকে মুহ‌্যমান রাজনীতিকরাও। মঙ্গলবার সৈয়দ হকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বুধবার বিকালে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠেয় আনন্দ আয়োজনটি স্থগিত করে শেখ হাসিনার ৭০তম জন্মদিন উদযাপন কমিটি। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারজয়ী এই লেখকের মৃত‌্যুতে শোক জানিয়েছেন। ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে চিকিৎসার জন্য গত এপ্রিলে যুক্তরাজ্য গেলে সৈয়দ হকের ক‌্যান্সার ধরা পড়ে। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে কিছু দিন চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিলে জীবনের বাকি দিনগুলো দেশে কাটানোর জন্য গত ১ সেপ্টেম্বর ফিরে আসেন তিনি। ফেরার পর থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন তিনি। গত ১০ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে তাকে দেখে এসে তার চিকিৎসার পুরো ব‌্যয়ভার নেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসপাতালে সোমবার দুপুরে সৈয়দ হকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার ভোর থেকে কৃত্রিম উপায়ে তাকে শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল।

দুপুরে তাকে দেখে এসে কবি মুহাম্মদ সামাদ সাংবাদিকদের বলেন, সঙ্কটাপন্ন হলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তাকে বিদেশে নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না। তার কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিয়ে জানিয়ে দেন, এই লেখক আর বেঁচে নেই। এসময় হাসপাতালে থাকা সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কান্নায় ভেঙে পড়েন। নূরলদীনের সারাজীবনসহ এই নাট‌্যকারের অনেক নাটকে অভিনয় করেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও হাসপাতালে ছুটে যান।

রাতে সংসদ অধিবেশন চলার সময় অনির্ধারিত আলোচনায় দাঁড়িয়ে বাণিজ‌্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ কবির মৃত‌্যুর কথা আইনসভার সদস‌্যদের জানান। তিনি বলেন, “আজ বিকালে সৈয়দ হক মারা গেছেন। আজীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা বুকে ধারণ করেছেন। যত্নের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। “তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। লেখনী ও দেশের হয়ে ভূমিকার রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীও তাকে শ্রদ্ধা করতেন।”
ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে কবির মরদেহ গুলশানে তার বাসা ‘মঞ্জু বাড়ি’তে নেওয়া হয়। স্ত্রী আনোয়ারার ডাক নামে এই বাড়ির নাম। কবি পরিবারের ঘনিষ্ঠ কবি পিয়াস মজিদ বলেন, “তিনি হাসপাতালে শয‌্যাশায়ী থাকা অবস্থায় বলে গিয়েছিলেন, তাকে যেন একবার বাসায় নেওয়া হয়। সেজন‌্য তাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল।” বাসা থেকে রাত ৯টার দিকে মরদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালে ফিরিয়ে নিয়ে হিমঘরে রাখা হয়। কবি পরিবারকে সমবেদনা জানাতে বাসায় যাওয়া তথ‌্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার সকাল ১০টায় লাশ নেওয়া হবে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর ১১টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন‌্য। দুপুরে জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার পর কুড়িগ্রামে নিয়ে তার নামে বরাদ্দ করা জমিতে এই কবিকে সমাহিত করা হবে বলে নাট‌্যব‌্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার জানান।

কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রসহ সাহিত্যের সব শাখায় স্বচ্ছন্দ সৈয়দ হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হোমিওপ‌্যাথিক চিকিৎসক সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও গৃহিনী হালিমা খাতুনের ঘরে। ১৯৫৩ সালে ‘একদা এক রাজ্যে’ কাব্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হলেও ‘তাস’ নামক গ্রন্থ আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর অবিরাম লিখেছেন সৈয়দ হক। সাহিত‌্যের সব শাখায়। তবে সব ছাপিয়ে কবি পরিচয়টিই প্রধান মনে করতেন তার সাহিত‌্যাঙ্গনের বন্ধুরা। বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা- এসব কাব‌্যগ্রন্থের অজস্র কবিতায় তার নানা নীরিক্ষা জনপ্রিয়তাও এনে দেয় তাকে। কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক নূরলদীনের সারাজীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, গণনায়ক, ঈর্ষা ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সীয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। তিনি মহাকাব্যিক পটভূমিকায় বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ নামে দীর্ঘ উপন্যাস যেমন লিখেছেন, তেমনি ছোট আকারের উপন্যাস লিখেছেন সমান তালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’সহ নানা উপন‌্যাসে। ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নীল দংশন’, ‘মৃগয়া’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘স্তব্দতার অনুবাদ’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘মহাশূন্যে পরানমাস্টার’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘অন্তর্গত’, ‘এক মুঠো জন্মভূমি’, ‘শঙ্খলাগা যুবতী ও চাঁদ’, ‘বাস্তবতার দাঁত ও করাত’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ ‘আয়না বিবির পালা’সহ ৫০টির বেশি উপন‌্যাস এসেছে তার হাত দিয়ে।

ছোটগল্পে তিনি নিজের এলাকা উত্তরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের জীবনের মর্মন্তুদ ছবি একেছেন। গত শতকের ষাট, সত্তর ও আশির দশকে অনেক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট‌্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের জন‌্য গানও লিখেছেন সৈয়দ হক। তার লেখা গান ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’র মতো বহু গান এখন মানুষের মুখে ফেরে। তার নিষিদ্ধ লোবান উপন‌্যাস নিয়ে কয়েক বছর আগে গেরিলা নামে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়।
সংবাদপত্রে কলাম লেখাকে আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে অনেকেই সৈয়দ হকের দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘হৃৎকলমের টানে’র কথা বলেন। সৈয়দ হকের আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’ও প্রশংসিত সাহিত‌্যাঙ্গনের মানুষদের কাছে।