মতামত

সামার ইন নিউইয়র্ক

গ্রীষ্মকালে নিউইয়র্কের একটি এলাকা
গ্রীষ্মকালে নিউইয়র্কের একটি এলাকা

গ্রীষ্মকালে নিউইয়র্কের একটি এলাকা

কথাটা এভাবে বলা যেত, নিউইয়র্কে সামার কিংবা নিউইয়র্কের গ্রীষ্মকাল। কোনো নামকরা লেখকের পরামর্শ চাইলে তিনি হয়তো ‘দাহকালের কথন’ ধরনের শিরোনাম দিতে বলতেন। তবু সিনেমা মার্কা এই শিরোনামটাই মনে ধরল। যেন লাভ ইন সিঙ্গাপুর কিংবা লাভ ইন ব্যাংককের মতো কোনো সিনেমার কাহিনি লিখছি।

আসলে কোনো কিছু মোটা দাগে বললে বা না লিখলে কেন যেন মাথায় ঢুকতে চায় না। অনুভূতিগুলি ভোঁতা হয়ে গেছে আজকাল। অতিরঞ্জন, অতিকথন ও রংচঙে কাগজে মোড়ানো সারা দুনিয়া। টাইম স্কয়ারের বিশাল সব বিলবোর্ডগুলোর তাকালে চোখ যেভাবে ঝলসে যায়, সেইরকম উজ্জ্বল, ঘোর লাগা সবকিছু।
নিউইয়র্কের সামার যেন এইরকমই।
উইন্টারের বিপরীতে সামার দেখলে এই সত্য যেন আরও গাঢ় ও স্পষ্ট হয়। জীর্ণ-শীর্ণ, শুষ্ক-বিদীর্ণ উইন্টারে মনটা কেমন যেন ভার হয়ে থাকে। তুষারে ঢেকে আছে চারদিক। সকাল-সন্ধ্যা ঘরে বন্দী। তদুপরি আছে ব্লিজার্ডের (এক ধরনের তুষার ঝড়) ভয়। খুব প্রয়োজনে বাইরে বের হলে সূর্যকে মনে হয় চাঁদের চেয়েও ম্যাড়মেড়ে। কোনো তেজই নেই যেন ব্যাটার। ওদিকে সামারে সূর্য ঝলসে দেয় সবকিছু। সবকিছুই যেন বেশি বেশি…প্রকৃতিতে রং-রূপ যেন উপচে পড়া।
এত কোলাহল, এত সবুজ, পথে-পার্কে-জঙ্গলে জীবনের এত স্পন্দন…তবু কি বিষণ্ন হয় না মন? থমকে দেয় না দুই মুহূর্ত?
আমার বাসা থেকে কাছের পার্কে যাওয়ার সময় প্রতিদিন একটা গাছের দিকে নজর আটকে যায়। গাঢ় সবুজ পাতার ওপর, হালকা হলুদ রঙা ফুল। এত ভালো লাগে যে, বলার নয়! প্লাস পাওয়ারের চশমা খুলে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি গাছটার দিকে।
বনফুলের বিখ্যাত ছোট গল্প নিমগাছের কথা মনে হয়। যে নিমগাছটা কোথাও যেতে পারে না। কারণ শিকড় চলে গেছে অনেক দূর। পাশের বাড়ির বউটির অবস্থাও অনেকটা ওর মতো। অচেনা গাছটা অনেকটা ফুলে ফুলে ছাওয়া নিমগাছের মতো দেখতে লাগে।
নামকরা, অভিজাত ফুলের তালিকায় নিশ্চয়ই নিমফুলের কোনো ঠাঁই হবে না। তবু কেন যেন ফুলটা আমার খুব প্রিয়। নিমগাছের মতো ওই গাছটা দেখতে দেখতে মনের মধ্যে অচেনা এক কষ্ট দলা পাকায়। চোখের পাতা অকারণে ভিজে ওঠে।
আহারে! আবার জীবনে একটা সামার পেলাম। আবার প্রকৃতির অসামান্য সবুজাভ শোভা উপভোগের সুযোগ ঘটল। কিছুদিন পরে আসবে ‘ফল’। মানে হেমন্তকাল। সবুজ পাতা হলুদ-লাল হবে। তারপর একদিন ঝরে পড়বে। তারপর উইন্টারে তুষারপাত এসে গাছটাকে ন্যাড়া করে দেবে। ডালে ডালে ফুটে থাকবে তুষার ফুল। আর মন কেমন করা দিনে ক্ষণে ক্ষণে একটা ভাবনাই উঁকি দেবে—আবার একটা নতুন সামার পাব তো জীবনে? আবার কি দেখতে পারব পথের ধারের সেই গাছটাকে? গাঢ় সবুজ পাতা যার। ফুলগুলি হালকা হলুদ।
জানি হঠাৎ অচেনা কোনো স্মৃতি কাঁদাবে?
স্মৃতি যে এমন নীরব ঘাতক, নিউইয়র্ক না এলে সে কী আগে কখনো জানতাম! সামারে এল না বলেই জানলাম। সব সময়ই স্মৃতি যে কাঁদায় তা কিন্তু নয়, মাঝে মাঝে মনটা আচম্বিতে ভালোও করে দেয়।
বেলভিউ হাসপাতালে ছোট ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে ট্রেন স্টেশনে ফিরছিলাম সেদিন। ম্যানহাটনের টুয়েন্টি এইট স্ট্রিটের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা গাছের দিকে নজর গেল। কিছুক্ষণ পরে বোধ হলো আমার মনটা কেন যেন আচম্বিতে খুব খুশি খুশি। অনেকক্ষণ চিন্তা করেও আনন্দের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে হলো গাছটা দেখতে অনেকটাই শৈশবের বড়ই গাছের মতো।
গেন্ডারিয়ায় আমাদের পুরোনো বাসার বড়ই গাছটায় ফল খুব ভালো হতো না। বেশির ভাগ বড়ই ছিল পোকায় ভরা। গাছ ভর্তি ছিল ছ্যাঙ্গা (যার পোশাকি নাম শুঁয়াপোকা)। তবু সেই ছ্যাঙ্গার ভয় এড়িয়ে, দেয়াল বেয়ে ছাদে উঠে (ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না), তারপর গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে দিনভর সেই বড়ই খেতাম। জামার কোচড় ভরে বড়ই জমাতাম। আজও তাই বড়ই গাছ দেখলে উদাস হয়ে যাই।
কেন যে যেখানে সেখানে স্মৃতিরা এভাবে ফাঁদ ফেলে রাখে? কেউ নয়, আমি কেবল ধরা খাই। স্পর্শকাতর মানুষের এই সমস্যা। স্মৃতির দিঘিতে ডুবে থাকতে ভালোবাসে। ওদিকে যে বেলা পড়ে আসে, সেই খেয়াল থাকে না।

কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট করে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে
তারকা, জোনাকি-সব; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি

(কবিতা বুঝিনি আমি, বিনয় মজুমদার)

নিউইয়র্কে এসে টের পেলাম, কী তীব্র আকুতি মানুষের সামারের জন্য।
অবশেষে সামার এল, কি বলেন?
এমনিতে এই শহরের মানুষ আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতে খুব ভালোবাসে। প্রায় প্রত্যেকেই ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সেই দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে বের হয়। সামার এলে তো কথাই নেই। চারদিকে যেন উৎসবের আমেজ। সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হতে থাকে পোশাক। সি বিচ ও পার্কে দৌড়ে, বসে, হেঁটে বা শুয়ে নানাভাবে লোকজন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে এই মৌসুমকে।
উইন্টারের বিপরীতে আমার সামার তেমন ভালো লাগে না। অসহ্য গরম, গাছের পাতায় কোনো কাঁপন নেই, বাংলাদেশের মতো বৃষ্টি নেই, লোমকূপগুলো যেন পুড়িয়ে দেয় তপ্ত কড়া রোদ। আর এই দেশীয় ললনাদের মতো সুযোগ কোথায় সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধানে। সেই থ্রি কোয়ার্টার, ফুলহাতা পরেই পথ চলি আর ওদের দেখে দীর্ঘশ্বাস লুকাই।
সামারে বাঙালি সেজেগুজে বনভোজনে মাতে এখানে। অথচ বাংলাদেশে সব পিকনিক হয় উইন্টারে। সামারে পার্কে বারবিকিউ পার্টি করে সব দেশের মানুষই। বিশাল গাড়িতে মেরিনেট করা চিকেন, করটিল্লা চিপস, সালসা আর চেয়ারটেবিল, চুলা নিয়ে পরিবারের সদস্যরা দিনভর গাছের তলায় পার্টি করে। কেউ বা বাড়ির সামনে বা পেছনের উঠানেও করে বারবিকিউ পার্টি।
ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকায় নিউইয়র্কের বাইরে বিভিন্ন শহরে বেড়াতে যায় বাঙালি পরিবারগুলো। অনেকে আবার নিউইয়র্কে বেড়াতে আসেন। অন্য রাজ্য থেকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে। অতিথিদের ঘিরে আড্ডা জমে। বাঙালি তো আড্ডা প্রিয় জাতি।
আড্ডা জমে বাড়ির পাশে পার্কে। সামারে দিন বড় বলে রাত নয়টা পর্যন্ত পার্কে থাকে সবাই। আশপাশের প্রতিবেশীরা একত্র হয়। নানা দেশের, নানা ভাষার, সংস্কৃতির মানুষ। সন্তানদের কারণে তারা এক জায়গায় বসেন। কারণ মা-বাবা যে ভাষাতেই কথা বলুন, সন্তানদের ভাষা একটাই-ইংরেজি। বাবা-মায়েরা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে পরস্পরের খোঁজ নেন। মনে মনে বিস্মিত হন এই ভেবে যে, পৃথিবীর সব মানুষেরই দুঃখ-কষ্ট-আনন্দের রং আর সন্তানবাৎসল্য একই।
এক সময় আড্ডা ভাঙে। দল বেঁধে বাড়ি ফেরার সময় আবছা আলোয় আবার সেই গাছটার দিকে চোখ পড়ে। সবুজ গাঢ় পাতা। হালকা হলুদ ফুল। অনেকটাই যেন নিম গাছের মতো। কিংবা ও হেনরির ‘দ্য লাস্ট লিফ’ গল্পের সেই গাছের মতো।
গাছটার দিকে চোখ পড়তেই আবার থমকে যাই। কথা বলা থেমে যায়। অকারণে আবার মনে হয়, কদিন পরে এই সবুজ পাতা, আর হালকা হলুদগুলো থাকবে না। উইন্টার এসে শুষে নেবে প্রকৃতির সমস্ত সুষমা। মনে সেই পুরোনো শঙ্কা জাগে—
আগামী উইন্টার শেষে আবার আরেকটি সামার পাব তো?