আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্ক

যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নের অংশীদার এবং আরো কিছু

americaমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রথমবারের মতো ঝটিকা সফরে ৯ ঘণ্টার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন গত ২৯ আগস্ট। মার্কিনমুলুক এই দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তির সফর জনগণের মনে জন্ম দিয়েছে নানা কথা, বিচিত্র ভাবনা এবং অনেক আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব। বড় বেশি কথা হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর রিভিউ মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। এ মামলার রিভিউ শুনানির তারিখ ছিল ৩০ আগস্ট এবং জন কেরি সাহেব এসেছেন ২৯ আগস্ট, দুটোর সঙ্গে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা— এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাবনার ঝড় তুলেছেন অনেকে। আপাতদৃষ্টিতে এসব ভাবনা কল্পনাপ্রসূত মনে হলেও এমনটি অকারণ নয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখনো ভুলেননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্তিমলগ্নে আমেরিকা হাজির হয়েছিল সপ্তম নৌ-বহর নিয়ে, স্বাধীনতাকে নস্যাত্ করবে বলে। তার পর জন কেরির পূর্বসূরি হেনরি কিসিঞ্জার বলতে শুরু করলেন, বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুড়ি। এই আমেরিকা পরোক্ষভাবে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটিকে অর্থের জোগান দিয়েছে স্বাধীনতার পর, যার সহযোগী হচ্ছেন মীর কাসেম আলী। এছাড়া জন কেরি হচ্ছেন সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, যিনি ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছেন এবং যার হাতে রক্তের দাগ আছে। এখন হয়েছেন ব্যবসায়ী।

এসব হচ্ছে অতীতের কথা, কিন্তু ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। অবশ্যই জন কেরির বাংলাদেশ সফর আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি প্রকাশ্য ভাষণে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শুধু উন্নয়ন অংশীদারই নয়, বন্ধু হতে চায়।

জন কেরির এবারের বাংলাদেশে আগমনের লক্ষ ছিল প্রধানত সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র হচ্ছে কয়েকটি নীতিগত বিষয়, যেমন— উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা। এছাড়া বিশ্বের সব দেশে মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত, জঙ্গিবাদের মতো অপশক্তিকে প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তাই আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে এসব বিষয় এসেছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। বহুদলীয় গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভাবনার সঙ্গে একবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই দেখি, শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি ছুটে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব প্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে অবশ্যই জঙ্গিবাদ নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রাপ্তি, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুক্লমুক্ত প্রবেশ, জিএসপি সুবিধা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা।

এছাড়া উপস্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি এএম রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়। তবে এ ব্যাপারে কোনো আশ্বাস মিলেছে বলে মনে হয় না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ফেরত পাঠানো সম্পর্কে তাদের অনেক বেশি নিয়মকানুন আছে। তাছাড়া জন কেরির হাতে সময় আছে মাত্র দুই মাস, তার পরই আসছে ভোট। সেখানে তার দল বিজয়ী হতে পারলে তবে কথা, নইলে তার পুরো সফরের অনেক বার্তা বা প্রাপ্তি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে।

বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, জন কেরির এ সফরের ফলে মনে হয় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সংযোজন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাফল্য প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে এবং হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ-সম্পর্কিত ভাবনা যে ভুল ছিল, তা অনুধাবন করতে পেরেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এর আগে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছেন কিন্তু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাননি। কিন্তু জন কেরি এবার বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে গেছেন, খুনিদের ছবি দেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে খুনের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

জন কেরির সফরের আরেকটি বড় দিক হচ্ছে, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের যে জিরো টলারেন্স দৃষ্টিভঙ্গি, তা সম্ভবত কেরি সাহেব অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি রাজি হয়েছেন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় তাদের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বিনিময় করতে এবং সন্ত্রাস দমনে ঐক্যবদ্ধভাবে ও একযোগে কাজ করতে। তবে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এসব ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে বলছেন। তাদের আবার সেই পুরনো কথা, যুক্তরাষ্ট্র গেয়েন্দা কার্যক্রমে অনেক বেশি পারদর্শী এবং তাদের ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে প্রসারিত।

বাণিজ্যিক ভুবনে বাংলাদেশের আগ্রহ অনেক বেশি। বাংলাদেশ চায় শিল্প, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা করলে দেশের জন্য বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে তারা যদি আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদিত পণ্য অধিক পরিমাণে আমদানি করে তাহলে শুধু যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বেশি হবে তা-ই নয়, প্রকারান্তরে বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়ন হবে। সামাজিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা হবে সুবিন্যস্ত ও সুদূরপ্রসারী। তাই ১৫ শতাংশ ট্যারিফ প্রদান থেকে বাংলাদেশকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ চেয়েছে একটি সমান সুযোগ বাংলাদেশকে প্রদান করা হোক, যেন বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে সমান সুযোগের ভিত্তিতে। জিএসপি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তিনি একমত হয়েছেন অর্থনৈতিক বাজার সম্প্রসারণে সহযোগিতা করতে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উপস্থিত থাকা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়নি, তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ নিয়ে কথা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রায়োরিটি কী, তা কেরি সাহেব জানতে চেয়েছেন। আমরা ডিউটি ও কোটা ফ্রি সুবিধার কথা বলেছি।’

খেয়াল রাখতে হবে তৈরি পোশাক শিল্পের অনুরূপ এখন বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প রফতানি বাজারে যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করেছে এবং বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রফতানি করতে শুরু করেছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আউটসোর্সিংয়ে সবচেয়ে অধিক সুযোগ গ্রহণ করে ভারত, চীন ও ফিলিপাইন। এসব সুবিধা আমাদের নিতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজন হবে ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। সেখানে আমাদের দুর্বলতা আছে বলে মনে হয়। তবে এখনো বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে। প্রথম স্থানে আছে চীন, তার পর ভিয়েতনাম এবং এর পরই বাংলাদেশ অধিক তৈরি পোশাক রফতানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

এসবের বাইরেও কিছু ক্ষেত্র আছে, যা সাম্প্রতিককালে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। রাজনৈতিক সম্পর্কের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, নীল অর্থনীতি বা বঙ্গোপসাগরে অর্থবহ বিনিয়োগ করতে জাপান, চীন ও ভারত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। রূপপুর পরমাণু বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থার মাত্রা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে সহজভাবে নিয়েছে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পে সহযোগিতা করা ছাড়াও বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া নিয়ে সাম্প্রতিককালে অনেকের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন পদ্মা সেতু ও সেতুর ওপর রেলওয়ে নির্মাণের সুযোগ পেয়েছে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের বিনিয়োগের পরিধি বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে, যাতে অনেকের গাত্রদাহ হতে পারে। আবার উগ্রবাদ দমনে অনেকের আগ্রহ আছে কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিতে হলে ভালোভাবে ভাবতে হবে। উগ্রবাদ দমন করতে গিয়ে সামাজিক অস্থিরতাকে যেন উত্সাহ দেয়া না হয়।

জন কেরির এ সফর যে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অত্যন্ত বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ জন কেরি বিদায়কালে টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের অসাধারণ একটি উন্নয়ন গল্প আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি বেশ আনন্দিত।’

যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বাংলাদেশকে অনেক কাজ করতে হবে। প্রধান কাজ হবে বৃহত্ বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি। শুধু দেশে সুশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়, অনেক আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুযোগ প্রদান করতে হবে বিনিয়োগকারীদের। শুধু ওয়ান স্টপ সার্ভিস বলে আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলে হবে না, অর্থবহ বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে করপোরেট ট্যাক্স হলিডে, আমদানির ওপর ট্যারিফ কনসেশন, দ্বৈতকর পরিহার, রেমিট্যান্সের সুবিধা, রেসিডেন্ট পারমিট, শুল্ক কর ও ভ্যাট, আয়করের সুবিধা এবং অন্যান্য সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড কাজ করছে প্রচুর, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামনে অগ্রসর হতে হবে।

বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, নইলে অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হবে না। উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার হ্রাস পাবে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বৃহত্ পুঁজিকে অংশীদার করতে হবে। এছাড়া শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবান জনসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সমাজজীবনে স্বস্তি আসবে।

লেখক: সাবেক সচিব