ভালো উদ্যোগের সঙ্গে যখন দূরদর্শিতাও যোগ হয় তখন যেকোনো অসম্ভবকেই সম্ভব করা যায়। এর উজ্জ্বল উদাহরণ মাইনুল খান। ১৮ বছর বয়সে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেইন্ট ক্লাউড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এর পরেই কাজ শুরু করেন ই-ব্যুরো নামের একটি স্টার্টআপ কোম্পানিতে। এখান থেকেই তিনি নিজের কোম্পানি শুরু করার অনুপ্রেরণা পান।
প্রথমে শুরু করেন টেকনিশিয়ান মার্কেটপ্লেস, যা ছিল মূলত টেকনিশিয়ান সার্ভিসের জন্য একটি মার্কেটপ্লেস। যদিও পরবর্তী সময়ে সেটা বিক্রি করে দেন তিনি। বেশ কিছুদিন নিরীক্ষার পর নিজের প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ব্যবসার ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবেই একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে। সবার মধ্যেই অন্যের অধীনে কাজ করার চেয়ে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার একটা চল শুরু হয়েছে। সবাই নিজে নিজের প্রতিভা দিয়ে নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় আছে। অধিকাংশ আমেরিকান কোম্পানিই দেখতে পেলেন ফুলটাইম কর্মীর চেয়ে ফ্রিল্যান্সার দিয়ে কাজ করাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। সেই চিন্তা থেকেই আবার শুরু করলেন মার্কেটপ্লেস, তবে এবার শুধু ফ্রিল্যান্সারদের জন্য। এই ফ্রিল্যান্সারদের জন্য মার্কেটপ্লেসই হলো ফিল্ড ন্যাশন। তিনি ফিল্ড ন্যাশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও। ফিল্ড ন্যাশন নিয়ে তিনি বলেন, ‘ফিল্ড ন্যাশন মূলত একটি ক্লাউড বেইজড মার্কেটপ্লেস, যেখানে দাতা ও গ্রহীতার পারস্পরিক যোগাযোগ ঘটে। নিজে হন্যে হয়ে খোঁজার চেয়ে একই জায়গায় চাহিদা অনুযায়ী দুই পক্ষের যোগাযোগ হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবসার কাজও সম্পন্ন হয়।’
একদিকে কম্পিউটার সায়েন্সের প্রোগ্রামিং এবং ডাটা অ্যানালাইসিসের ব্যাকগ্রাউন্ড আর অন্যদিকে ব্যবসায়ী মনোভাব দুয়ে মিলিয়ে মাইনুল খান বেশ সফলতার সঙ্গে কোম্পানির কাজ শুরু করলেন। আর সেই সঙ্গে মানুষ হিসেবে সবার প্রতি তার বিনয়ী ও কোমল মনোভাব তাকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর।
আমেরিকায় মাইনুল খান যথেষ্ট সফল একজন ব্যবসায়ী। আর্থিক হিসাব সবসময় মানদণ্ড না হলেও উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলারের উপর মোট আয় করেছেন ২০১৫ সালে। এছাড়া তিনি এ বছরে সম্মানজনক আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং উদ্যোক্তার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। সেই সঙ্গে আমেরিকান টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেন।
বিদেশে যতই জনপ্রিয় হোন না কেন, নিজের শিকড় ভুলে যাননি মাইনুল খান। প্রথম থেকেই ফিল্ড ন্যাশনের অফিস বাংলাদেশ ও আমেরিকা—দুই দেশেই ছিল। বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, প্রোডাক্ট ম্যানেজারসহ অন্যান্য বিষয়ের কর্মকর্তা হিসেবে অনেককেই নেওয়া হয়েছে। ফলাফল স্বরূপ, ফিল্ড ন্যাশন ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি একাধিক বছর ‘ইঙ্ক’ ম্যাগাজিন এই ফিল্ড ন্যাশনকে আমেরিকার সবচেয়ে উচ্চবৃদ্ধির কোম্পানি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এখন পর্যন্ত ফিল্ড ন্যাশনে প্রায় এক লক্ষের মতো ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। এছাড়া ফুলটাইম কাজ করছেন এমন কর্মকর্তা আছেন ১৪৫ জন। ফিল্ড ন্যাশনের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন, তাদের সবাই নিজের কাজের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। ফিল্ড ন্যাশন বর্তমানে পৃথিবীর একটি অন্যতম প্রধান অনলাইন মার্কেটপ্লেস কোম্পানি, যেখানে একই সঙ্গে কর্মকর্তা ও গ্রাহকের আইডিয়ার প্রতি লক্ষ রাখা হয়। মাইনুল বিশ্বাস করেন, ফিল্ড ন্যাশনে কর্মকর্তাদের চিন্তাধারা এবং অবদান বহু মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে। একটি কাজ তখনই মহান হয়, যখন তার অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে, মানুষের কল্যাণের মন্ত্র থাকে। ফিল্ড ন্যাশনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষ তাদের কাজ ভালোবাসে, এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ক্যারিয়ারকেও উন্নত করার আশা রাখে। ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা হিসেবে মাইনুল এদেশে আরও বড় আকারে কাজ শুরু করতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন এদেশেও অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। তবে কাজের ক্ষেত্রে মূল্যবান সম্পদের জোগান পাওয়া কিছুটা দুষ্কর হবে বলে মাইনুল মনে করেন। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করবেন, যেখানে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে।
ফিল্ড ন্যাশন নিয়ে মাইনুল খানের স্বপ্ন অনেক। স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ করেছেন, এখনো স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছেন, আর ক্রমাগত নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।