নিউ ইয়র্ক

নিউইয়র্কে নাট্যজন সেলিম আল দীনকে স্মরণ

selimবাংলাদেশের তরুণ সমাজ যখন প্রাচ্য ও ইউরোপের নাটকে মনোনিবেশ করেছিলেন তখনই সেলিম আল দীন বাংলা নাটক জনপ্রিয় করার জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সেলিম আল দীনকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে স্মরণ করা হয় না, জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে মিশন বা কনস্যুলেটে কোনো আয়োজন থাকে না। ১৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ৬৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নাট্যকার সেলিম আল দীন স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

নিউইয়র্ক থিয়েটার এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। থিয়েটারের অন্যতম সংগঠক শিবলী সাদিকের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার কাজী আরিফ। বক্তব্য দেন সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রধান সম্পাদক ফজলুর রহমান, নিউইয়র্ক থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা মুজিব বিন হক, বাংলাদেশ সোসাইটির কালচারাল সেক্রেটারি মণিকা রায় ও কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট গোপাল সান্যাল প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, সেলিম আল দীন বড় অসময়ে চলে গেছেন পরপারে। আজ তার ৬৭তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। অথচ ১০ বছর আগে তার প্রয়াণ হয়েছে। এই ১০ বছরে নাট্যকার সেলিম আল দীন বাংলাদেশের বা বাংলা ভাষাবাসীর মাঝে নাটককে আরও কতশত গণমুখী করতে পারতেন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নাট্যজগত। সবাইকে স্বীকার করতে হবে সেলিম আল দীনের অবদান বাংলা নাটকে অনস্বীকার্য।
তারা বলেন, সেলিম আল দীনের জন্মবার্ষিকী জ্যাকসন হাইটসের একটি হল রুমে করার কথা ছিল না। প্যারিস ও পাশ্চাত্যের নাট্যকারদের জন্মদিন ও প্রয়াণ দিবস নিউইয়র্কের সে দেশের মিশন বা কনস্যুলেট ঘটা করে আয়োজন করে থাকে। কিন্তু আমাদের মিশন ও কনস্যুলেটে সেলিম আল দীনরা উপেক্ষিত, যা দুঃখজনক।
নাট্যকার ও গবেষক সেলিম আল দীনের ৬৭তম জন্মবার্ষিকী ছিল ১৮ আগস্ট। ১৯৪৯ সালের এই দিনে ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে তাঁর জন্ম৷ ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ৷ ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন৷ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করটিয়ায় সাদত কলেজে৷ সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ৷ ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটকের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন। যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে যোগদান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য-নির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফকে নিয়ে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ কেন্দ্রিক এথনিক থিয়েটারেরও তিনি উদ্ভাবনকারী। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বাসন, মুনতাসীর, শকুন্তলা, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল, পুত্র ও বন পাংশুল ইত্যাদি। রেডিও-টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটকের মধ্যে আছে বিপরীত তমসায়, ঘুম নেই, রক্তের আঙ্গুরলতা, অশ্রুত গান্ধার। একাত্তরের যিশু, ভাঙা প্রেম, অশেষ বিশেষ, কাঁদো নদী কাঁদো ইত্যাদিও তাঁর সৃষ্টি।
সেলিম আল দীন তার সৃষ্টিকর্মের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, কথাসাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি।
বাংলা নাট্য জগতে অসামান্য অবদান রাখা সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।