হাইলাইটস

চট্টগ্রামের নামি শিল্পপতির অবাক প্রেম-প্রতারণার শিকার তরুণী ফ্যাশন ডিজাইনার

মামলায় ফাঁসানো ছাড়াও পাচ্ছেন প্রাণনাশের হুমকি

চট্টগ্রামের মেয়ে হলেও তিনি ঢাকাভিত্তিক সফল ফ্যাশন ডিজাইনার। পড়েছেন নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিলেন নামি আবাসন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদেও। লাবণ্য (ছদ্মনাম) তার নাম। স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকেন। নিজের ডিজাইন করা পোশাক নিয়ে অনলাইন ও অফলাইনে ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত দিন যায় তার। এর মধ্যেই হঠাৎ ঝড়ের মতো এলো ভালোবাসার ডাক— সারাজীবন পাশে থাকার আশ্বাস। ফেসবুকে যোগাযোগের সূত্র ধরে চট্টগ্রামের এক নামি শিল্পপতি বুঝে ফেলেন তার একাকীত্ব। সেই সুযোগটি নিয়ে শিল্পপতি ফেললেন ‘ভালোবাসার’ টোপ। যদিও শিল্পপতির ঘরে আছে বউ আর দুটো বাচ্চা। চতুর ছেলে সেটা সামাল দিয়ে বোঝালেন, ‘এক ছাদের নিচে বউ আছে ঠিক, কিন্তু সম্পর্ক নেই বহুদিন। মন পড়ে আছে শুধুই তার ওপর।’ স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া লাবণ্য খড়কুটো আঁকড়ে রাখার মতো নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন ছেলেটাকে ঘিরে।

এরপর এখন থেকে প্রায় একবছর আগে ফেসবুক ছাড়িয়ে দুই জোড়া চোখ এক হলো গাজীপুরের এক রিসোর্টে। দিনে দিনে সেই প্রেম-ভালোবাসা গাঢ় হতে থাকে আরও। ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে দুজনের মধ্যে মেলামেশাও হতে থাকে নানা জায়গায়। কিন্তু ঠিক এক বছর পর হঠাৎ স্বরূপে দেখা দিলেন শিল্পপতি। গত মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) সেই প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম শহরে এসে লাবণ্য বুঝতে পারেন প্রেম ও বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে তার সঙ্গে মূলত প্রতারণাই করা হয়েছে। শিল্পপতির ছেলের মূল লক্ষ্যই ছিল আসলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন। এটাই যেন তার খেলা!

বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) কোনো উপায় না দেখে লাবণ্য ছুটে যান শিল্পপতির বাসায়। সেখানেও শিল্পপতির সাড়া না পেয়ে প্রতারণার শিকার লাবণ্য ফেসবুক লাইভে এসে জানালেন নিজের হতাশা ও প্রতারণার শিকার হওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনী। পরদিন শনিবার (২৯ আগস্ট) উদ্ভ্রান্ত মেয়েটি আবার ছুটে যান সেই শিল্পপতির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তীব্র হতাশা ও অপমানে নিজের হাতের শিরায় ব্লেড চালিয়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন।

যার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক এই অভিযোগটি উঠেছে, তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক নামি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘প্যাসিফিক জিন্স’-এর পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালকও। পুলিশ তার বাসা থেকে উদ্ধার করে লাবণ্যকে নিয়ে আসার পর রোববার (৩০ আগস্ট) চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় শিল্পপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরের বিরুদ্ধে।

ইউএসবিডিনিউজকে লাবণ্য বলেন, ‘তানভীর আমাকে ট্র্যাপ করেছে। আমি বুঝতেই পারিনি। সে প্রথম থেকেই বারবার বলে আসছিল— ‘আই অ্যাম লোনলি ফ্রম ইনসাইড, ডিভোর্স না হলেও স্ত্রীর সাথে ছোট বাচ্চাটা হওয়ার পর আমার কোন সম্পর্ক নেই। তোমাকে খুব ভালোবাসি বলেই তোমার সাথে সম্পর্ক করতে চাই। তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’ এসব কথা বলে আমার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে তানভীর।’

সম্পর্কের শুরুতে মুঠোফোন ও মেসেজ আদান-প্রদানের সম্পর্ক থাকলেও বিয়ের ‘নিশ্চিত’ আশ্বাসে তানভীর বারবারই দেখা করতে চাইতেন— এমনটি জানিয়ে লাবণ্য বলেন, ‘২০১৯ সালের ১ নভেম্বর প্রথম দেখা হওয়ার দিনেই ঢাকার গাজীপুরের গ্রিনভিউ রিসোর্টে নিয়ে গিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে তানভীর। সে সবসময়ই আমাকে নিশ্চয়তা দিতো এই বলে— ‘ভেরি সুন আই উইল মেরি ইউ।’ এরপর নভেম্বর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মতোই আমাদের নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক হয়ে আসছিল।’

চট্টগ্রামের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করা লাবণ্য বলেন, ‘গত ২৫ আগস্ট আমি ওর সাথে দেখা করতে চট্টগ্রামে এসেছিলাম। আমি জানতাম না সে সম্পর্কটিকে এভাবে অস্বীকার করতে পারে। আমি তানভীরের বাসায় যাই। সেখানে তারা খুব বাজে ব্যবহার করে আমার সঙ্গে। আমি বুঝতে পারি, অনেক বড় প্রতারণার শিকার হয়েছি আমি। এমন প্রতারণার পর আমি মরে যেতেই চেয়েছি।’

গত মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) চট্টগ্রামে আসার পর লাবণ্যের সঙ্গে তানভীর দেখা করেন চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বোট ক্লাবে। সেখানে গাড়িতে বসেই তাদের মধ্যে কথা হয় প্রায় একঘন্টা।

ঘটনার শিকার লাবণ্য বলেন, ‘গাড়ি থেকেই তানভীর হঠাৎ আমার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে আমার বাবাকে ফোন করে। আমার বাবাকে সে জানায়— আগামী দুই দিনের মধ্যে আমাকে বিয়ে করবে। এরপর হঠাৎ করেই ওই দিন থেকে তানভিরের ফোন বন্ধ পাই। মেসেঞ্জারেও আর তাকে পাই না। তার সঙ্গে যোগাযোগ হুট করে বন্ধ হয়ে যায়। এমন আকস্মিক ঘটনা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমি ওইদিন মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) তানভিরের বাসায় যাই।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লাবণ্য বলেন, ‘ওই বাসায় আমাকে কেউ অ্যাটেন্ড করেনি। ওয়েটিং প্লেসে বসিয়ে রাখা হয়। দীর্ঘক্ষণ পর তানভীরের বাবা (প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন) আসেন। তাকে আমি সব খুলে বললে তিনি আমাকে তানভিরের সাথে কথা বলে বাকিটা জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। আমি এরপর তানভীরের বাসা থেকে চলে আসি। এরপরও তারা যোগাযোগ করে না। তানভীরের সাথেও আমার যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর রোববার (৩০ আগস্ট) রাতে তানভীরের বাড়ির সামনে গিয়ে ব্লেড দিয়ে নিজেকে আহত করি।’

লাবণ্য বলেন, ‘জানেন আপু আমার ইচ্ছে ছিল ওর বাড়ির সামনেই আমি মারা যাব। পুলিশ এসে সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যায়।’

‘প্যাসিফিক জিন্স’-এর পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি হাতড়ে লাবণ্য বলেন, ‘সে ঢাকাতে এসে আমার সাথে প্রথমবার দেখা করে গত বছরের নভেম্বরে। স্বভাবতই আমি প্রথম দেখা হওয়া নিয়ে অনেকটাই আনন্দ বোধ করছিলাম। কিন্তু আমি অবাক হলাম যখন সে প্রথম দেখা হওয়ার দিনেই আমাকে রিসোর্টে নিয়ে যায়। এতে আমার খুব মন খারাপ হয়। সবাই তো ভালবাসার মানুষের সাথে প্রথম দেখার অনেক স্মৃতি জমা করে রাখে। কিন্তু তাকে সেটি আর বলি না। সেখানে গিয়ে সে বারবার আমাকে শারীরিক সম্পর্ক করতে সিডিউস (প্রলুব্ধ) করে। সে বারবার চেষ্টা করলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি। একটা পর্যায়ে এসে সে আমার সাথে জোর করেই যৌন সম্পর্ক করে।’

পুরো ব্যাপারটাকে একটি ‘ধর্ষণের ঘটনা’ বলে বর্ণনা করে লাবণ্য বলেন, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই। বলতে গেলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কিন্তু তানভীর আমাকে বারবার বোঝাচ্ছিল যে, সে দীর্ঘদিন ফিজিক্যালি ডিপ্রাইভ (শারীরিক সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত) থাকায় এমনটি ঘটেছে। সে বলছিল, চোখের সামনে ভালবাসার মানুষকে পেয়ে নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এরপর একটা সময়ে আমি কনভিন্স হয়ে যাই। কারণ সামহাউ তাকে আমি ভালোবাসতাম।’

তানভীর বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক— এটা জানার পরও কেন তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেন— এমন প্রশ্নে লাবণ্য বলেন, ‘সত্যি বলতে কী, আমি কোনো বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে যেতে চাইনি। কেউ আমাকে ‘স্ন্যাচার গার্ল’ বলুক— তা চাইনি। স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে কেড়ে আনা মেয়ে বা ঘর ভেঙ্গে দেওয়া মেয়ে বলে কেউ আমাকে অভিযুক্ত করুক— তাও চাইনি কখনও। সচেতনভাবেই এসব বিষয় থেকে দূরে থেকেছি। কিন্তু পরিচয়ের পর তানভীর আমাকে বলেছে, তার সাথে তার ওয়াইফের কোনো সম্পর্কই নেই। তারা কেবল নামেই বিবাহিত। হি ইজ এলোন ফ্রম ইনসাইড। ডিভোর্স না হলেও তারা দুজনই পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকতো। তাদের মধ্যে অনেক বছর ধরে কোন শারীরিক সম্পর্ক ছিল না বলেও জানায় সে।’

করোনা পরিস্থিতিতে ঢাকায় থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই তানভীরের সঙ্গে লাবণ্যের কথা হতো ফোনে ও ভিডিওকলে। করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও মেসেজ আদান-প্রদান ও ফোনকলে সেই সম্পর্ক দিনে দিনে গাঢ় হচ্ছিল— এমনটি জানিয়ে লাবণ্য বলেন, ‘সে সব সময়েই আমাকে বিয়ে করার কথা বলতো। সে সবসময়ই বলতো— ‘ভেরি সুন আই উইল মেরি ইউ।’ আমাকে বিয়ে বিয়ে করার বিষয়ে তার পরিবারের কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছে অনেকবার। আমি ইমোশনালি খুব অ্যাট্রাকটেড হয়ে যাই তার প্রতি।’

ফ্যাশন ডিজাইনার লাবণ্য বলেন, ‘তানভীর আমাকে স্বামীর মতই গাইড করত। আমার প্রত্যেকটি লাইফস্টেপ আমি তার পরামর্শে করতাম। আমাকে সে নামাজ পড়তে বলত। একসাথে হজ করাবে বলত। সে অনেকবার বলেছে আমাদের সম্পর্কের কথা তার মাকেও নাকি সে বলেছে। এরপর তো একটা মানুষকে আর অবিশ্বাস করা যায় না! আমি তার সাথে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ভীষণ জড়িয়ে পড়ি। তার বাড়ির ওপরের তলার জিম থেকে সে আমাকে প্রতিদিন আমাকে ভিডিয়ো কল দিত। কাজ শেষে বাসায় ফিরেও আমাকেই ফোন দিয়ে জানাত সে বাসায় ফিরেছে। যোগাযোগটা ছিল স্বামী-স্ত্রীর মতই।’

একসময় শীর্ষস্থানীয় একটি আবাস প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে চাকরি করা লাবণ্য বলেন, ‘কোন পুরুষকে তার পরিবার থেকে ছিনিয়ে আনা ‘স্ন্যাচার গার্ল’ বলুক কেউ— এটা আমি কখনোই চাইনি। কোন পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের বলিও হতে চাইনি। আমি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। তানভীর মিথ্যে বলেছে এটা আমি এখনও ভাবতে পারছি না, ভাবছিও না। কিন্তু সে তো আমাকে বিয়ে করার কথা বলেছিল। তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক নেই বলেছিল। এভাবেই একটি বছর গেছে। এখন সে অস্বীকার করছে— এটা কি প্রতারণা নয়? টাকার জোরে প্রভাব খাটিয়েই কি সে বেঁচে যাবে?’

২৫ আগস্ট চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই লাবণ্যকে বিভিন্ন মহল থেকে যোগাযোগ করে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া ছাড়াও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে— এমন অভিযোগ করে লাবণ্য বলেন, ‘সবকিছু জেনে আমার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমিও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত।’