মতামত

আমার দ্বিতীয় বাবা ও হজের স্মৃতি

hajjহবু শ্বশুর–শাশুড়ির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়া যে কোনো মেয়ের জন্যই খুব অস্বস্তিকর ও অনিশ্চিত ঘটনা। উপরন্তু আমার হবু শাশুড়ি বেশ লম্বা চওড়া, প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। প্রথম সাক্ষাৎ ওনার সঙ্গেই। ভিতু ভিতু আমি স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি বেশি লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে গেলাম। হবু শ্বশুরের পোস্টিং ঢাকার বাইরে। প্রথম যেদিন দেখা হলো, দিনটা আমার আজও মনে আছে। তিনি বিশেষ কিছুই বলেননি, শুধু ভীষণ সুন্দর একটা হাসি দিয়েছিলেন। সেই একটা হাসি আমাকে আশ্বস্ত করে দিল যে, আমাকে ওনার অনেক ভালো লেগেছে। আমার পাশে তিনি সব সময়ই আছেন আর বাবার স্নেহ থেকে আমি কোনো দিন বঞ্চিত হব না। তিনি বাস্তবে খুব কম কথা বলেন, কিন্তু এত কম কথা বলে একজন মানুষ কীভাবে তার অপার স্নেহ অন্যদের মাঝে ঢেলে দেন এটা আমার কাছে এক বিরাট বিস্ময়।

তিনি একবার কানাডা বেড়াতে এসেছেন একা আমাদের কাছে। আমি দ্বিতীয়বার কনসিভ করেছি। শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে দিয়ে মিষ্টি আর আমার জন্য একটা হিল ছাড়া স্যান্ডেল কিনিয়ে আনলেন। সেই স্যান্ডেল পরে আমি পুরো প্রেগনেন্সি পার করলাম। ১৯ বছরের পুরোনো বউ, এখনো সুন্দর করে সাজলে বাবা বলেন, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মা। এই রংটা তো তোমাকে খুব মানিয়েছে। একটা কিছু রান্না করলে সেই কথা বছরের পর বছর বলতে থাকেন। সেই কবে আমার হাতের কই পাতুরি খেয়েছেন, এখনো সবাইকে গল্প করেন।
২০০৭ সালে আমার বর চাকরি পাওয়ার পর সে ঠিক করল বাবা–মাকে নিয়ে হজ করতে যাবে। তার ছোটবেলা থেকেই শখ, চাকরি পেলে বাবা–মাকে হজ করাবে। মা–বাবাও সেই আশায় বসে আছেন। আমাদের বাচ্চারা ছোট, মেয়েটার বয়স আড়াই বছর। ঠিক করলাম আব্বু–আম্মুর কাছে দেশে ওদেরকে রেখে আমিও যাব। হজের আগে আগে আমি হঠাৎ​ করে বেশ অসুস্থ। দেশে বাচ্চা যখন রাখতে গেছি, তখনো শিওর না হজে যেতে পারব কিনা। মনটাকে শক্ত করে চলে গেলাম। বাবার হাঁটতে কষ্ট হয়। একা একা হজের ভিড়ে তাওয়াফ করা ওনার পক্ষে অসম্ভব। ওনাকে হাতে ধরে পুরো হজ করিয়েছি আমি আর আমার বর। সঙ্গে সব সময় ছোট্ট একটা টুল থাকত। যেন ওনাকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসতে না হয়। বিদায়ী তাওয়াফের সময় আমি একা বাবার সঙ্গে ছিলাম। প্রথমে খুব ভয় লাগছিল। একা মেয়ে তাওয়াফ করাই প্রচণ্ড কঠিন। এই অসুস্থ মানুষকে আমি দেখে রাখতে পারব তো? ছোট্ট ছেলেকে যেভাবে আগলে রাখে, সেভাবে সব ভিড় থেকে আগলে আগলে যখন তাওয়াফ শেষ হলো আমার মনে হলো আমার একটা বড় দায়িত্ব শেষ হলো।
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে, আরাফাত থেকে মুজদালিফা যাওয়ার সময় বাসে প্রচণ্ড ভিড়। ভিড় আর গরম মিলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমরা বাসে অনেক কষ্টে একটা আসন ম্যানেজ করলাম। আমার বর অনেক কষ্ট করে এটা করল। কিন্তু বাবা অতিশয় সজ্জন মানুষ, ভদ্র ও স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তিনি ইতস্তত করছিলেন যে, আমার শাশুড়ি দাঁড়িয়ে যাবেন আর উনি বসবেন কীভাবে? এই ফাঁকে আরেক লোক সেই আসনে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে এই ধকল নিতে না পেরে তিনি জ্ঞান হারানোর মতো পর্যায়ে চলে যান। সেদিন মনে হয়েছিল, কী হতো আমরা যদি সঙ্গে না থাকতাম? আজ হজ, ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। এই খুব কম কথা বলা শান্ত নিরীহ মানুষটি সারা জীবন মাথার ওপরে ছায়া হয়ে থাকুন।